শুরুর সেই উষ্ণতা কোথায় যে হারিয়ে গেল!‌

কে বড় ফুটবলার, পেলে নাকি মারাদোনা?‌ তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই তর্ক চলছে। পেলের জন্ম ১৯৪০ এ, মারাদোনার ১৯৬০ এ। বয়সের ব্যবধান কুড়ি বছরের। দু’‌জন দুটো ভিন্ন সময়ের প্রতিনিধি। কিন্তু তারপরেও তর্ক চলেছে নিজের নিয়মে। দুই কিংবদন্তির মৃত্যুর পরেও এই তর্কের বিরাম নেই। দুদিকেই কিছু অকাট্য যুক্তি আছে। শুধু দ’‌জনের সমর্থকরাই এই তর্ক চালিয়ে গেছেন, এমন নয়। পেলে ও মারাদোনা, দু’‌জনেই কথার যুদ্ধে জড়িয়েছেন বারবার। মারাদোনা মাঝে মাঝেই পেলেকে আক্রমণ করেছেন। পেলেও সময় বুঝে কটাক্ষ করেছেন।
তবে, শুরুতে সম্পর্কটা কিন্তু এমন ছিল না। সম্পর্কটা অনেক পুরনো। মারাদোনা যেমন পেলেকে শ্রদ্ধা করতেন, ঠিক তেমনি পেলেও মারাদোনাকে প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। সম্পর্কটা নিছক শ্রদ্ধা আর স্নেহে আটকেও ছিল না। তার থেকে অনেক বেশিই ছিল। মারাদোনার বয়স যখন ১৮, তখন থেকেই তাঁকে চেনেন পেলে। সেবছরই (‌১৯৭৮)‌ বিশ্বকাপের ট্রায়াল ম্যাচে মারাদোনার দুরন্ত ফুটবল দেখে চমকে যান। মারাদোনার সঙ্গেও দেখাও হয়। ছেলেটির সহজ–‌সরল ভাব, নম্র ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলেন। জহুরি যেমন জহরকে চেনে, তেমনই পেলে চিনে নিয়েছিলেন মারাদোনাকে। তখনই বলেছিলেন, এই ছেলে একদিন অনেকদূর যাবে। ১৯৭৯–‌এ আর্জেন্টিনার লিগে তিন নম্বর হল আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স। মারাদোনাকে ঘিরেই ছিল প্রত্যাশা। তাই রাগটাও গিয়ে আছড়ে পড়ল তাঁরই ওপর। রাতে ঠিকঠাক ঘুমোতেও পারেননি মারাদোনা। কোথায় ভুল হচ্ছে, কেন পারছেন না, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। মারাদোনার এক আত্মীয় ছিলেন পেলের পরিচিত। তিনি পেলের সঙ্গে কথা বললেন। পেলে তাঁকে বললেন, ম্যাচের ক্যাসেট নিয়ে দিয়েগো যেন রিও ডি জেনেইরোর সেরা হোটেল কোপাকাবানা প্যালেসে চলে আসেন।
৯ এপ্রিল, ১৯৭৯। মারাদোনা হোটেলে পৌঁছেই দেখেন স্বয়ং পেলে তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য লাউঞ্জে অপেক্ষা করছেন। পেলে তাঁকে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। মারাদোনা নিজের খেলার ক্যাসেট দেখাতে চাইলেন। পেলে বললেন, আগে বিশ্রাম করো। নানা বিষয় নিয়ে গল্প শুরু করলেন। সেই আলোচনায় ফুটবল ছিল না। গিটার বাজিয়ে মারাদোনাকে গানও শুনিয়েছিলেন। এরপর দুজন মিলে নেমে গেলেন রেস্তোরাঁয়। একসঙ্গে ডিনার সারলেন। ওদিকে, মারাদোনা ছটফট করছেন, ফুটবল নিয়ে তো কথাই হচ্ছে না।
আসলে, পেলে চেয়েছিলেন পরিবেশটাকে হালকা করতে। মারাদোনাকে চাপমুক্ত করতে। ডিনার সেরে পেলে ক্যাসেট দেখতে শুরু করলেন। কোথায় কোথায় ভুল হচ্ছে, আক্রমণকে কীভাবে আরও তীক্ষ্ম করা যায়, কীভাবে প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে হয়, বুঝিয়ে দিলেন। মারাদোনার বুকের ওপর থেকে যেন পাথর সরে গেল। ফিরলেন অফুরন্ত অক্সিজেন নিয়ে। পরের ম্যাচেই দুরন্ত হ্যাটট্রিক। পরের দুই মরশুমে করলেন ২৬ ও ৪৩ গোল। পরপর তিন বছর মারাদোনাই আর্জেন্টিনার লিগে তিনিই সর্বোচ্চ গোলদাতা। পরপর দু’‌বার লাতিন আমেরিকার বর্ষসেরা ফুটবলারও হলেন মারাদোনা। ১৯৮২ তে তাঁর হাতে বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন পেলে। বলেছিলেন, ‘‌তুমি আমার থেকেও বড় ফুটবলার হবে।’‌ একটি বল উপহার দিলেন। সেই বলের ওপর লিখলেন, ‘‌ভবিষ্যতে মারাদোনা বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে।’‌ সেই বলটি সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন মারাদোনা।
সম্পর্কে চিড় ধরল ১৯৮২ থেকে। মারাদোনা বার্সিলোনায় যাচ্ছেন শুনেই পেলে নিষেধ করলেন। বললেন, ওখানে গেলে তুমি অনেক টাকা পাবে ঠিকই, কিন্তু তোমার ফুটবল জীবনের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। এখনই ইওরোপে যাওয়ার সময় আসেনি। কিন্তু মারাদোনা পেলের পরামর্শ না মেনে বার্সিলোনায় সই করেন। এতে পেলে কিছুটা ক্ষুন্ন হন। তাঁর কথাকে অমান্য করে মারাদোনার বার্সিলোনায় চলে যাওয়া খোলা মনে মানতে পারেননি। তবে যা অশঙ্কা করেছিলেন, তার অনেকটাই মিলে গেল। চোটের জন্য বড় সময় কাটাতে হল মাঠের বাইরে। ইওরোপীয় ফুটবলের আবহে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতেও পারলেন না। ছিয়াশিতে মারাদোনাকে নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। নিজের দেশ ব্রাজিলকেই এগিয়ে রাখেন। বলেছিলেন, মারাদোনা কমপ্লিট ফুটবলার নয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রায় একক কৃতিত্বে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করলেন মারাদোনা।
১৯৯০ বিশ্বকাপের আগে পেলে বলে বসেন, ‘‌মারাদোনা কেবল বাঁ পায়ের ফুটবলার। ওর ডান পা ঠিকঠাক চলে না। এমনকী হেডেও সুবিধা করতে পারে না। বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কাছে মারাদোনা এখন আটকে যাবে।’‌ এসব কথা শুনে মারাদোনা ফের চটে গেলেন। প্রায় একার চেষ্টায় দলকে ফাইনালে নিয়ে গেলেন। বিতর্কিত পেনাল্টিতে হারতে হল আর্জেন্টিনাকে। এমনিতেই মেজাজ ভাল ছিল না। তার ওপর পেলের কিছু মন্তব্যে ফের আঘাত পেলেন। সবমিলিয়ে সম্পর্কটা কিছুতেই আগের জায়গায় রইল না। তা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছলো পেলের ৫০ তম জন্মদিনের ম্যাচে মারাদোনা না খেলায়।
তাই তিক্তটা যেমন সত্যি, চাপানোতর যেমন সত্যি, তেমনই শুরুর সেই উষ্ণতামাখানো দিনগুলোও মিথ্যে নয়।

‌‌‌‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.