প্রথমেই অকপটে একটি স্বীকারোক্তি সেরে নেওয়া যাক। ছিয়াশিতে আমার জন্মও হয়নি। তাই সেই উন্মাদনা কেমন ছিল, বলতে পারব না। শুনেছি, সেই ছিয়াশি থেকেই নাকি বাঙালি দু’ভাগ হয়ে গেছে। একদল ব্রাজিলের। একদল আর্জেটিনার।
অনেককেই ছিয়াশির স্মৃতিচারণ করতে শুনি। বেশ বুঝতে পারি, সেই স্মৃতিচারণে বিস্তর জল মেশানো। আসলে, সবাই দেখাতে চান, তাঁরা ছিয়াশি থেকেই ফুটবল দেখছেন। কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ হয়ত তা নয়। হিসেব কষে দেখেছি, যাঁরা এমন স্মৃতিচারণ করছেন, তাঁদের অনেকের তখন বয়স ছিল চার বছর বা পাঁচ বছর। আমার মতোই কারও কারও হয়ত জন্মই হয়নি।
আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটটাও মাথায় রাখা দরকার। তখনও মফস্বলে সেভাবে টিভি সংস্কৃতি গজিয়ে ওঠেনি। গ্রাম তখনও টিভির মানচিত্র থেকে দূরে। আধা শহরে টিভি এলেও তা তখনও গুটিকয় বিত্তশালী বাড়িতেই শোভাবর্ধন করত। অনেকে সেই বাড়িতেই টিভি দেখতে ভিড় জমাতেন। এমনকী শহর অঞ্চলেও তখনও টিভি নামক বস্তুটি তেমনভাবে মধ্যবিত্তের বাড়িতে প্রবেশাধিকার পায়নি।
বরং পরের চার বছরে এর অনেকটাই বিস্তার ঘটল। বেশিরভাগ বাড়িতে টিভি ঢুকল ওই ছিয়াশি থেকে নব্বই এই চার বছরে। সেদিক থেকে ছিয়াশি নয়, অধিকাংশ বাঙালির বিশ্বকাপ দর্শন ওই নব্বই সাল থেকে।
তাহলে লোকে ছিয়াশির গল্প শোনায় কেন? এ অনেকটা সেই কপিলদেবের ১৭৫ রানের মতোই। যে ইনিংসের কোনও ভিডিও স্বয়ং কপিলদেবের কাছেও নেই। সেদিন বিবিসির একটা ধর্মঘট থাকায় টিভিতে সম্প্রচারও হয়নি। অর্থাৎ, কারও সামনেই ওই ইনিংস দেখার কোনও সুযোগই ছিল না। কিন্তু এমন ঐতিহাসিক একটা ইনিংস। দেখিনি বললে সমাজে মানসম্মান থাকে না। প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার একটা বাসনা মানুষকে আবহমানকাল ধরেই তাড়া করে। সেই তাড়না থেকেই লোকে বলে, উফ, কপিলদেবের সেই ইনিংস। এখনও চোখের সামনে ভাসে। সেই তাড়না থেকেই মানুষ বলে, ছিয়াশিতে মারাদোনার যে ফুটবল দেখেছিলাম, সারা জীবন ভুলব না।
তবে কপিলের সেই ইনিংসের থেকে একটু ফারাক আছে। সেই ইনিংস পরেও দেখা যায়নি। কিন্তু মারাদোনার ওই খেলাগুলো বা ওই গোলগুলো পরে বারবার দেখা গেছে। এখন ইউটিউবের দৌলতে তো আরও সহজে, যখন ইচ্ছে দেখা যায়। অর্থাৎ, সেই গোলগুলো, ঠিকানা লেখা পাসগুলো দেখেছেন। কিন্তু পরে। আর পরে যখন দেখেছেন, তখন সেটা ছিয়াশিতে দেখেছি বলে চালিয়ে দেওয়াই যায়। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষদর্শী থাকার এতখানি সুযোগ যখন হাতের মুঠোয়, সেটাকে গ্রহণ করাই যায়।
সেই কারণেই বাঙালি দেখুক বা না দেখুক, ছিয়াশি সেই মিথ হয়েই আছে। অনেকেই প্রমাণ করতে চান, তখন থেকে তিনি আর্জেন্টিনা। অথচ, অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, তখন হয়ত আর্জেন্টিনার নামটাই শোনেননি। বা শুনলেও তাঁর মনে সেই আবেগটাই তৈরি হয়নি। এবারও যদি মেসিরা শুরুতেই বিদায় নিতেন, হয়ত এতখানি ছিয়াশির ঢেঁকুর উঠত না। যেই মেসিরা একের পর এক বাধা টপকে গেলেন, যেই ফাইনালের দিকে এগিয়ে গেলেন, অমনি ছিয়াশির সঙ্গে তুলনা বাড়তে লাগল। শুধু মেসিতে মুগ্ধ হলে প্রেস্টিজ থাকে না। জনসমাজে কল্কে পাওয়া যাবে না। তাঁর সঙ্গে মারাদোনাকে জুড়তে হবে। তবে একটু জাতে ওঠা যাবে।
ছিয়াশি নিয়ে অন্তত আমার পর্যবেক্ষণ এটাই। অনেকেই হয়ত একমত হবেন। অনেকের দ্বিমত থাকবে। আসলে, ইতিহাসের প্রবাহটাই এমন। একটা সাফল্য আরেকটা সাফল্যের স্মৃতিকে ফিরিয়ে দেয়। কখনও সত্যিকারের স্মৃতিচারণে। আর যদি সত্যিকারের স্মৃতি না থাকে, তবে কল্পনার রঙ মিশিয়ে স্মৃতির সফর তো আছেই।