Categories Uncategorized

লর্ডস যেন বঙ্গ জীবনের অঙ্গ

নির্মল দত্ত

ঠিক চোদ্দ বছর আগের কথা। তখনও ছিল পুজোর আবহ। অষ্টমীর বিকেল। প্রেস কনফারেন্সে এলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। পরের দিন খেলা। তার আগে এটা–‌সেটা বলে গেলেন। ম্যাচের আগে ক্রিকেটাররা যা বলে থাকেন!‌ প্রেস কনফারেন্স শেষ। তিনি উঠে বেরিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ ফিরে এলেন। জানালেন, এই সিরিজের পরই আমি অবসর নিচ্ছি।

হঠাৎ যেন বাজ পড়ল। সন্ধে থেকে টিভিতে এই প্যান্ডেল, ওই প্যান্ডেল দেখানোর কথা। কোথায় কত ভীড়, কোথায় ধুনুচি নৃত্য হচ্ছে, এসব দেখানোর কথা। সব আলো যেন একাই নিয়ে নিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। চ্যানেলে চ্যানেলে তখন শুধুই সৌরভকে নিয়ে আলোচনা। বাঙালির পুজোটা একেবারেই যেন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

চোদ্দ বছর পর। এবার আরও এক বাঙালি। এবার তাঁর অবসরের বাদ্যি। এবার অবশ্য হঠাৎ করে নয়। গত কয়েক বছর ধরেই ঝুলন গোস্বামীকে শুনতে হচ্ছিল, কবে অবসর নিচ্ছেন। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, বিশ্বকাপের পরই সরে দাঁড়াবেন। মেয়েদের যেমন পঁচিশ পেরোলেই বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হয়, তেমনই যদি কারও বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে যায়, তাঁকে তো অবসর নিয়ে প্রশ্ন শুনতেই হবে। আর ৩৯ হলে তো কথাই নেই।

তাই ঝুলন গোস্বামীর অবসরের মধ্যে আর যাই হোক, আকস্মিকতা নেই। বরং এটা অনেকটা স্বাভাবিকই ছিল। এতদিন নিচ্ছিলেন না, এই যা। কিন্তু অবসরের মঞ্চ যদি লর্ডস হয়, এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে!‌ ঝুলন সরকারিভাবে একবারও বলেননি, কবে তিনি অবসর নিচ্ছেন। কিন্তু সতীর্থরাই বলতে শুরু করলেন, ‘‌এটা ঝুলুদির শেষ সিরিজ। আমরা তাকে দারুণভাবে বিদায় দিতে চাই।’‌ শুরু থেকেই যদি এমন আবহ সঙ্গীত বাজতে থাকে, তখন বিদায়বেলার রিংটোনটা বেশ বিষাদময় হওয়ারই কথা।

ভারত ইংল্যান্ডের মাটিতে শেষ সিরিজ জিতেছিল ২৩ বছর আগে। এবার একদিনের সিরিজে প্রথম দুটি ম্যাচই জিতে নিল ভারত। ফলে, সিরিজ পকেটে। শেষ ম্যাচ নেহাতই নিয়মরক্ষার। হারলেও সিরিজ জয়ের উল্লাস করতে বাধা নেই। তার ওপর খেলা হবে লর্ডসে।

এই লর্ডসেই টেস্ট অভিষেক হয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলির। প্রথম টেস্টের সেই সেঞ্চুরি যেন রূপকথা হয়ে আছে। বাংলার আরেক আইকন! তাঁর শুরুটা ভারতের মাটিতে হলেও শেষ একদিনের ম্যাচ খেললেন কিনা লর্ডসে। কজনের এমন সুযোগ হয়!‌ একজনের ঐতিহাসিক অভিষেক। একজনের ঐতিহাসিক বিদায়। দুই আইকনের সৌজন্যে লর্ডসও যেন হয়ে উঠল ‘‌বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’‌।

লর্ডসের লং রুম থেকে নেমে আসছেন ঝুলন গোস্বামী। সতীর্থরা যেন তাঁরই অপেক্ষায়। দু’‌পাশে সারি দিয়ে দাঁড়ালেন। কখনও হাততালি। কখনও চোখের জল। ম্যাচের প্রতিটা মুহূর্তেই মনে হয়েছে, এ যেন ঝুলনেরই ম্যাচ। এমন বর্ণাঢ্য বিদায় কজন পেয়েছেন?‌

এমন বিদায়ই তো প্রাপ্য ছিল চাকদা এক্সপ্রেসের। অনাগত বায়োপিকের সৌজন্যে গত কয়েক বছরে তাঁর নামটাই বদলে গেছে। সেই চাকদা থেকে উঠে আসার লড়াইটা মোটেই মসৃণ ছিল না। সেই কাকভোরে উঠে সাইকেলে চাকদা স্টেশন। সেখান থেকে শিয়ালদায় নেমে দক্ষিণ কলকাতার বিবেকানন্দ পার্ক। তখনও ভালভাবে আড়মোড়া ভাঙেনি এই শহরের। সময়টা ভেবে দেখুন। আজ থেকে প্রায় বছর পঁচিশ আগে। তখন মেয়েদের ক্রিকেট ব্যাপারটাই কেমন একটা দূরগ্রহের ব্যাপার ছিল। কলকাতায় বাড়ি হলে তবুও কথা ছিল। এই মেয়ে কিনা থাকে চাকদা থেকেও অনেক ভেতরে। সেখান থেকে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখা যায়!‌

স্বপ্নের উড়ান সেখান থেকেই শুরু। বাংলা, অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দল। এমন ছোট ছোট হার্ডলস পেরিয়ে মাথায় উঠল জাতীয় দলের টুপি। প্রথমে ওয়ান ডে। এক সপ্তাহ পরেই খুলে গেল টেস্টেরও দরজা। একটার পর একটা মাইলস্টোন। কখনও আইসিসির বিচারে বর্ষসেরা ক্রিকেটার। কখনও দেশের অধিনায়ক। কখনও সর্বাধিক উইকেট শিকারি। কখনও অর্জুন হয়ে পদ্মশ্রীর মঞ্চে।

দুটো ছোট্ট তথ্যের উল্লেখ না করলেই নয়। সময়টা ২০০৯। অভিষেক হচ্ছে পাঞ্জাবের এক তরুণীর। নাম হরমনপ্রীত কাউর। দলের অধিনায়ক তখন ঝুলন গোস্বামী। কাট টু ২০২২। ঝুলনের বিদায়ী ম্যাচ। দলের অধিনায়কের নাম?‌ সেদিনের সেই হরমনপ্রীত কাউর।

আরও একটা ছোট্ট তথ্য, ঝুলন যখন দেশের হয়ে প্রথম খেলতে নামেন, তখনও জন্মই হয়নি শেফালি ভার্মা, রিচা ঘোষদের। আজ এঁরাই ঝুলনের সতীর্থ। এঁরাই মাঠের মাঝে ঝুলনকে জড়িয়ে ধরছেন। হাও হাও করে কাঁদছেন।

জীবন বড়ই বিচিত্র। কোন বাঁকে কোন চিত্রনাট্য লেখা থাকে, কেউ জানে না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.