বেরিয়ে আসার রাস্তা কোহলিকেই খুঁজতে হবে

সরল বিশ্বাস

অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়।

আটের দশকের জনপ্রিয় একটি ছবি। সেখানে নাসিরুদ্দিন শাহ কথায় কথায় রেগে যান। কেউ ভাল কথা বললেও বেঁকে বসেন। আমাদের বিরাট কোহলির হয়েছে সেই দশা। তিনিও বোধ হয় নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না।

যে কোনও খেলার অনিবার্য নিয়ম, ভাল খেললে সবাই মাথায় তুলে নাচবে, কিন্তু পারফরমেন্সের গ্রাফ পড়তে শুরু করলেই সেই ভক্তরাই বেসুরো গাইবে। যারা মাথায় তুলে নাচছিল, তারাই গালমন্দ করবে। আগে সেই গালাগাল উড়ে আসত গ্যালারি থেকে। এখন সেই গালাগালের নতুন নাম ট্রোলিং। ঘরে বসে মোবাইলে টাইপ করেই দিব্যি ক্ষোভ–‌রাগ উগরে দেওয়া যায়।

এতদিন কোহলির ব্যাটে রান ছিল। তাই তাঁর মস্তানিটাও অন্যদের হজম করতে হয়েছে। নির্বাচকদের পাত্তা দেননি। কলার তুলে ঘুরেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমার দল, আমি যাকে খুশি খেলাব। তোমরা নাক গলাতে এসো না। প্রাক্তনদের বুঝিয়েছেন, তোমরা কোন যুগে খেলেছো, লোকে ভুলে গেছে। আমার রেকর্ড তোমাদের থেকে অনেক ভাল। আমার জনপ্রিয়তা তোমাদের থেকে অনেক বেশি। অতএব, আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। সতীর্থদের বুঝিয়েছেন, এখন টিকে থাকতে গেলে আমাকে তোয়াজ করেই চলতে হবে। নইলে তুমি বৃত্তের বাইরে। মিডিয়াকে বুঝিয়েছেন, তোমরা কে হে!‌ এতদিন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। তাই তোমরা অনেক বীরত্ব দেখিয়েছো। তাই আগের তারকারা তোমাদের চটাতে চায়নি। কিন্তু আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ লক্ষ ফ্যান। আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে একখানা ছবি সাঁটাব, অমনি লাইকের বন্যা বয়ে যাবে। পরদিন সব কাগজগুলো হামলে পড়ে সেই ছবি ছাপবে। তাই তোমাদের পাত্তা দেওয়ার কোনও দরকার নেই।

হাতি কাদায় পড়লে কী হয়!‌ স্বভাবতই সবাইকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছেন। কোহলির ব্যাটে রান থাকলে হয়ত বাকিদেরও চুপ থাকতেই হত। কিন্তু সমস্যা হল, ব্যাটে রান নেই। শেষ কবে সেঞ্চুরি করেছেন, নিজেও ভুলে গেছেন। তার ওপর দল হারছে। দল হারলে অধিনায়কের সমালোচনা তো হবেই। টি২০ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই লজ্জাজনক বিদায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে দুই ঘরানাতেই সিরিজে হার। টি২০–‌র নেতৃত্ব আগেই ছেড়েছেন। একদিনের নেতৃত্বে তাঁকে সরিয়ে আনা হয়েছে রোহিত শর্মাকে। টেস্টের নেতৃত্বও খুব  নিরাপদ ছিল না। দেওয়াল লিখন কিছুটা পরিষ্কার হয়ে আসছিল।

এতদিন বিরাট কোহলি বোর্ডকে চাপে রেখেছিলেন। সুযোগ বুঝে বোর্ডও পাল্টা চাপ ফিরিয়ে দিচ্ছে। সেই স্নায়ুযুদ্ধ কিন্তু থামার কোনও লক্ষণ নেই। ঘরের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজ। ভারত হয়ত ড্যাং ড্যাং করে জিতবে। তারপর আসছে শ্রীলঙ্কা। এই সিরিজেও জয় নিয়ে কোনও সংশয় নেই। যদি কোহলির ব্যাটে রান না থাকে, ঘরে–‌বাইরে চাপ ক্রমশ বাড়বে।

এরই মধ্যে কোহলির সামনে শততম টেস্টের হাতছানি। সূত্রের দাবি, কোহলি নাকি বেঙ্গালুরুতে শততম টেস্ট খেলতে চেয়েছিলেন। তাই চেয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই টেস্টের সিরিজ হোক। কিন্তু তাঁর এই আবদারে বোর্ড কর্ণপাত করেনি। তাই তিন টেস্টের সিরিজ। কিন্তু ঘটনা হল, মাঝের টেস্ট জোহানেসবার্গে কোহলি সরে দাঁড়ালেন। পিঠের ব্যথা দাবি করলেও সেটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না বোর্ডের কাছে। তাঁদের ধারণা, বেঙ্গালুরুতে শততম টেস্ট খেলবেন বলেই দক্ষিণ আফ্রিকায় একটা টেস্ট তিনি এড়িয়ে গেলেন। ফলে, দেশের মাটিতেই শততম টেস্ট খেলার সুযোগ। এখনও পর্যন্ত যা প্রাথমিক সূচি, তাতে প্রথম টেস্ট বেঙ্গালুরুতে, দ্বিতীয় টেস্ট মোহালিতে হওয়ার কথা। বোর্ড সভাপতি এর মধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, বেঙ্গালুরু টেস্ট হবে গোলাপি বলের, অর্থাৎ দিন–‌রাতের।

কিন্তু এরই মাঝে অন্য একটা খবরও হাওয়ায় ভাসছে। আগে টি২০ সিরিজ সেরে নিয়ে তারপর হয়ত টেস্টের আয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথম টেস্ট হয়ত হতে পারে মোহালিতে, দ্বিতীয় টেস্ট বেঙ্গালুরুতে। তাই যদি হয়, তাহলে মোহালিতে শততম টেস্ট খেলতে হবে কোহলিকে। যতই বেঙ্গালুরুতে গোলাপি বলের টেস্ট হোক, সেটা হবে ১০১ তম। যদি সত্যিই সেটা হয়, তাহলে সেই স্নায়ুযুদ্ধ আরও বাড়বে। সংঘাতটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এর আগেও অনেকে নেতৃত্ব ছেড়েছেন। সুনীল গাভাসকার, শচীন তেন্ডুলকার, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা নেতৃত্ব ছেড়েছিলেন ব্যাটিংয়ে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করবেন বলে। তাঁরা ফোকাস রেখেছিলেন ব্যাটিংয়ে। কিন্তু কোহলির ক্ষেত্রে সমস্যা হল, তিনি এখনও মেনে নিতে পারছেন না। এখনও ভেতরে ভেতরে গুমরে থাকছেন। ব্যাটিংয়ের সময় তার প্রভাব পড়ছে। পড়তে বাধ্য।

সানি বা শচীনরা ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগত পরিসরেই রাখতে পেরেছিলেন। জনতার সামনে বেআব্রু করেননি। কিন্তু এই তারকাদের সঙ্গে কোহলির তফাত হল, কোহলি হলেন ছবির কাঙাল। জিম করেন, তাও পোজ দিয়ে। বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাও পোজ দিয়ে। উইকেট পড়ার পর যে উল্লাস, সেটাও সেই ক্যামেরার দিকে তাকিয়েই। মনোবিদরা বলে থাকেন, যাদের ছবির প্রতি আসক্তি যত বেশি, তারা তত বেশি আত্মকেন্দ্রিক। তাদের পক্ষে ‘‌টিমম্যান’‌ হয়ে ওঠা তত বেশি কঠিন।

কোহলিরও হয়েছে সেই অবস্থা। তাঁর পক্ষে এখন আর টিমম্যান হয়ে ওঠা সহজ নয়। আমার সাম্রাজ্য চলে গেল, সবসময় এরকম একটা ভাবনাই তাড়া করছে তাঁকে। আর এই ভাবনা যতক্ষণ না ঝেড়ে ফেলছেন, ব্যাটিংয়ে ফোকাস করা সহজ নয়। বরং নিজেকে আরও বেশি করে চাপের চক্রব্যূহে এনে ফেলছেন। বেরিয়ে আসার রাস্তা তাঁকেই খুঁজতে হবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.