অজয় কুমার
বাংলাদেশের দুর্গাপুজো নিয়ে কয়েকদিন ধরেই নেট দুনিয়ায় হইচই। গত কয়েকদিনে যেদিকে গেছি, ঘুরেফিরে একটাই আলোচনা। বাংলাদেশে কী হয়েছে, শুনেছেন? আর তো পুজো করাই যাবে না। আজ বাংলাদেশে মন্দির ভাঙছে। কাল এখানে ভাঙবে। সেদিন আর দূরে নেই।
মোটামুটি একই সুরে বাজছেন অনেকে। সেই তালিকায় সবজি বিক্রেতা যেমন আছেন, পুজোর প্যান্ডেলে আড্ডা দেওয়া নামী ব্র্যান্ডের জিনস পরা লোকটিও আছেন। যে পারছে, সোশ্যাল সাইটে ভিডিও আপলোড করে দিচ্ছে। সঙ্গে নিজের মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছে।
কেউ কেউ চিরাচরিত অভ্যেসের বশে বামপন্থীদের গাল পেড়ে যাচ্ছে। কুমিল্লায় একদল তাণ্ডব চালাল,তার জন্যও যেন এখানকার বামপন্থীরা দায়ী। কেউ বলছেন, বুদ্ধিজীবীরা নীরব কেন? কেউ বলছেন, টিভি চ্যানেলগুলিতে এইসব ভিডিও দেখানো হচ্ছে না কেন?
যেন দেশে আর কোনও সমস্যা নেই। এমনকী, রাজ্যেও আর কোনও সমস্যা নেই। পাওয়া গেছে একটা মোক্ষম বিষয়। এটা নিয়ে চলুক তর্জা।
সত্যিই, ভাবতেও অবাক লাগে। কোন খাতে বইছে আমাদের চিন্তা–চেতনা। কোনও সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে একদল দুষ্কৃতি যা করেছেন, তা চরম নিন্দনীয়। ধিক্কারের ভাষা নেই। এদের একটাই নাম দুষ্কৃতি। কঠোরভাবে এদের চিহ্নিত করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। স্পর্শকাতর বিষয় বলে অপরাধীরা যেন কোনওভাবেই ছাড়া না পায়। রাষ্ট্র যেন ভোটের বাধ্যবাধকতা ভুলে গিয়ে যথার্থ রাজধর্ম পালন করে। ভাবতে ভাল লাগছে, এই দাবি নিয়ে কোনও স্তরেই তেমন দ্বিমত নেই। দলমত নির্বিশেষে প্রায় সবাই সেই অপরাধীদের শাস্তি চাইছেন। বাংলাদেশ সরকারও তেমনই পদক্ষেপ নিয়েছে ও নিচ্ছে।
কিন্তু এই ঘটনাকে নিয়ে আমাদের বাংলায় যা হচ্ছে, সেটাও কি খুব গৌরবের। বাংলাদেশের একদল দুষ্কৃতি তাণ্ডব করল বলে আমাদের বড় একটা অংশ সেই পুরনো অসভ্যতা শুরু করে দেবেন? সেই হিংসা ছড়ানোর খেলা চালিয়ে যাবেন? না, এর জন্য বিজেপিকে একা দায়ী করে লাভ নেই। আমাদের অনেকের ভেতরেই ধর্মের সুড়সুড়ি পেলেই একটা বিকৃত মানসিকতা জেগে ওঠে। তারা ঘৃণা ছড়িয়ে ভাবে হিন্দু ধর্মের তারা কতই না শুভাকাঙ্খী। বাংলাদেশের সেই দুষ্কৃতিদের চেনা যায়, ধিক্কার দেওয়া যায়। কিন্তু সেই ঘটনাকে ব্যবহার করে যারা ক্রমাগত এই হিংসাকে আরও ছড়িয়ে দিতে চাইছেন, তাদেরও সুবোধ বালক বলি কী করে?
একটা জিনিস দেখে ভাল লাগছে। বাংলাদেশের সরকার অনেক বেশি দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কড়া ভাষায় নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়েছেন। দুষ্কৃতিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সন্দেহ নেই, তাঁরা অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। আমাদের শাসকরা এই ঝুঁকি নিতে পারবেন? বলতে পারবেন বাবরি ভাঙাও একইরকম নিন্দনীয়? বলতে পারবেন, যাঁরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে, তাঁদের আমরা ঘৃণা করি? উল্টে সেই নিন্দনীয় ঘটনাকে ‘জনতার ভাবাবেগ’ বলে চালাতে চান। যে বিচারপতি বাবরি ভাঙার সব অভিযুক্তকে বেকসুর খালাসের রায় দেন, তাঁকে অবসরের পরেই তড়িঘড়ি রাজ্যসভায় পাঠিয়ে পুরস্কৃত করেন।
এখানেই তফাত। ছোট দেশ হয়েও যে দৃঢ়তা ও সৎসাহস বাংলাদেশ সরকার দেখাতে পারে, এত বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই সৎসাহস দেখাতে পারেন না। তিনি সত্যিই বড় অসহায়। সংখ্যাগুরুকে উস্কে দেওয়া খুব সহজ কাজ। এর জন্য বীরত্ব লাগে না। কিন্তু সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়িয়ে সংখ্যাগুরুর কাজের নিন্দা করতে হিম্মৎ লাগে বই কি। সেই হিম্মৎ কি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আছে!