বন্ধুকে বাঁচাতে গানও গাইতে হয়েছিল

গায়িকা সুচিত্রাও জানতেন চ্যালেঞ্জ নিতে। লিখেছেন স্বনাম গুপ্ত।
যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন। না, এখানে সুচিত্রা সেনের রান্না নয়। বিষয় সুচিত্রা সেনের গান। তিনি আবার গান গাইতেন নাকি? এই প্রজন্ম শুনলে হয়ত পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে। শুধু এই প্রজন্ম কেন, যাঁরা উত্তম–সুচিত্রা বলতে পাগল, তাঁরাও হয়ত বিস্মিত হবেন।
কিন্তু এটা ঘটনা সুচিত্রা সেন গান গেয়েছিলেন। ছবিতে গেয়েছিলেন। এমনকি মেগাফোন কোম্পানির হয়ে গান রেকর্ডও করেছিলেন।
হঠাৎ গান গাইতে গেলেন কেন? নতুন কোনও চমক তৈরি করার জন্য? একেবারেই না। সময়টা ১৯৫৯। নায়িকা হিসেবে তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। অগ্নিপরীক্ষা, শাপমোচন, সবার উপরে, সাগরিকা, শিল্পী, হারানো সুর— এসব ছবিকে ঘিরে বাঙালি তখন উত্তাল। একের পর এক ছবির অফার আসছে। সময়ের অভাবে ফিরিয়েও দিতে হচ্ছে। এমন সময় গান রেকর্ডিং? গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা?
গানের অভ্যেসটা অবশ্য পুরনো। গানের গলাটা মন্দ ছিল না। রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতেন চমৎকার। কিন্তু রেকর্ডিংয়ে আসার নেপথ্য কাহিনীটা একটু অন্যরকম। মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার কমল ঘোষের অনুরোধেই তাঁকে রেকর্ড করতে হয়। আরও ভালভাবে বলতে গেলে, বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতেই তাঁকে গান গাইতে হয়েছিল।
গানের দুনিয়ায় মেগাফোন কোম্পানির বেশ সুনাম ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, অনেকেই রেকর্ড করেছেন মেগাফোন কোম্পানির হয়ে। কিন্তু একসময় সেই সুনাম ফিকে হয়ে এল। বাজারে তখন আরও অনেকে এসে গেছেন। সেই সুনাম আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। মেগাফোনকে নতুন করে চাঙ্গা করতে গেলে কী করতে হবে? কমলবাবু দ্বারস্থ হলেন সুচিত্রা সেনের। আবদার করলেন মেগাফোনকে চাঙ্গা করতে তাঁকে রেকর্ড করতে হবে। সুচিত্রা জানতেন, অনেক বিরূপ সমালোচনা হতে পারে। গান ভাল না লাগলে ছবিতেও তার প্রভাব পড়তে পারে। তবু ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কমলবাবুর অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারেননি।

suchitra10
তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, ঠিক করলেন আধুনিক গান রেকর্ড করবেন। একপিঠে রইল ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে আসবে কি/আমায় তুমি আগের মতো তেমন ভালবাসবে কি?’ আরেক পিঠে বনে নয়, আজ মনে হয়/যেন রঙের আগুন প্রাণে লেগেছে। দুটি গানই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা। সুর দিয়েছিলেন বারীন চট্টোপাধ্যায়। দুটি গানই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
শুধু বন্ধুত্বের তাগিদে রেকর্ডিং রুমে চলে গিয়েছিলেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কমলবাবুর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘নায়িকা থেকে গায়িকা হওয়ার জন্য কী অসাধ্যসাধন করেছেন। গান রেকর্ড করার আগে দিনের পর দিন আমাদের গড়িয়াহাটের বাড়িতে সুরকার রবীনদার সঙ্গে বসে গানের রিহার্সাল দিয়েছেন। গাইয়ে না হয়েও জেদ ধরে গান শিখে যে রেকর্ড করা যায়, তা আমি প্রথম দেখলাম সুচিত্রা সেনকে।’ এখানেই শেষ নয়, এরপর গৃহদাহ ছবিতেও একটা গান তিনি নিজে গেয়েছিলেন।
নায়িকা সুচিত্রা বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন থেকে যাবেন। কিন্তু গায়িকা না হয়েও একটা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে যেভাবে গান করতে এগিয়ে এসেছিলেন, সেই ইতিহাসটাও জানা দরকার। নইলে মহানায়িকাকে জানার মধ্যে অনেক ফাঁক থেকে যাবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.