দেবায়ণ কুণ্ডু
বছর ছয়েক আগের কথা। সেবারও লোকসভা নির্বাচনের আগে গোটা দেশজুড়ে মোদি ঝড়। মোদি যে ক্ষমতায় আসছেন, সেই দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় বাংলা থেকে ডাক পড়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলির। শোনা যায়, মোদি নাকি তাঁকে বাংলার কোনও কেন্দ্র থেকে দাঁড়াতে বলেছিলেন। যদি বাংলার কোনও কেন্দ্র নিরাপদ মনে না হয়, সেক্ষেত্রে গুজরাট থেকে দাঁড়ানোর প্রস্তাবও ছিল। তাতেও যদি আপত্তি থাকে, সরাসরি কেন্দ্রের ক্রীড়ামন্ত্রী করে রাজ্যসভায় জিতিয়ে আনার প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার মহারাজ।
এই বিষয়টি মোদিও কখনও প্রকাশ্যে আনেননি। সৌরভও প্রকাশ্যে বলেননি। কিন্তু খবর নিজের নিয়মেই ছড়িয়ে যায়। হয়ত তাতে কিঞ্চিত অতিরঞ্জন মিশে যায়। কিন্তু ছয় বছর আগে সৌরভের কাছে যে লোভনীয় প্রস্তাব ছিল, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। প্রশ্ন হল, সৌরভ কেন রাজি হননি? প্রথমত, তিনি রাজনীতি থেকে দূরেই থাকতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই রাজ্যে বিজেপির কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। তাই খামোখা এমন নৌকোয় উঠতে যাবেন কেন? রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কটা খারাপ করতে যাবেনই বা কেন? মন্ত্রী হিসেবে শপথ হয়ত নেওয়া যেত, অন্য রাজ্য থেকে জিতেও আসা যেত। কিন্তু ‘প্রিন্স অফ ক্যালকাটা’কে যদি নিজের রাজ্যেই ব্রাত্য থাকতে হয়, তার থেকে দুঃখের আর কী হতে পারে!
কিন্তু গত এক বছরে ছবিটা অনেকটাই বদলে গেছে। বিশেষত লোকসভা নির্বাচনের পর। সরকারের গ্রাফ পড়তির দিকে। একবার সেই গ্রাফ নামতে শুরু করলে ফের তোলা বেশ মুশকিল। প্রশান্ত কিশোর নানা তুকতাক করছেন ঠিকই, কিন্তু তা ব্যুমেরাং হয়েই ফিরে আসছে। লোকসভাতেই বিজেপির অনুকূলে প্রবল হাওয়া ছিল। যত দিন যাবে, সেই হাওয়া আরও বাড়বে। ছ মাস পর বিজেপি এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসতেই পারে। অন্তত সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু একটাই প্রশ্ন। দলের মুখ কে? রাহুল সিনহা বা দিলীপ ঘোষকে সামনে রেখে লড়াই করলে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে? মুকুল রায়কে কি সামনে আনা হবে? নাকি তৃণমূল শিবিরে আরও ভাঙন ধরবে? শুভেন্দু অধিকারী বা এই গোছের কোনও বড় নামকে সামনে আনা হবে? এই মুখ যদি সৌরভ গাঙ্গুলি হয়! অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রথমত, বিজেপিতে সেই বিশ্বাসযোগ্য মুখ নেই। তৃণমূল থেকে ভাঙিয়ে আনা মুখ কতখানি বিশ্বাসযোগ্য হবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মুখ হতেই পারেন সৌরভ গাঙ্গুলি।
ছ’বছর আগে মোদির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও এখন কিন্তু পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। এমনিতেই বিজেপি–র পক্ষে জোরালো হাওয়া। তার ওপর সৌরভ এসে গেলে তো কথাই নেই। তিনি জেলায় জেলায় ঘুরলে জনপ্লাবন এসে যাবে। এমনকী বাম বা তৃণমূল মনষ্ক ভোটাররাও সৌরভকে বেছে নিতে দ্বিধা করবেন না। বিজেপিকে ঘিরে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, সৌরভ গাঙ্গুলির নামে তা অনেকটাই কেটে যেতে পারে।
নেতৃত্ব কীভাবে দিতে হয়, সৌরভ সারা বিশ্বকে দেখিয়েছেন। প্রশাসনক হিসেবে তিনি যে যোগ্য, সিএবিতে পাঁচ বছর ধরে দেখিয়ে যাচ্ছেন। বোর্ড সভাপতি হয়ে অল্প সময়েই দারুণ ছাপ রেখেছেন। কোন কাজটা কাকে দিয়ে করাতে হয়, কীভাবে করাতে হয়, বেশ জানেন। ফ্রন্টফুটে গিয়েও পরে ব্যাকফুটে এসে কীভাবে কভার ড্রাইভ করতে হয়, কোন বলটা স্টেপ আউট করে ছক্কা হাঁকাতে হয়, তিনি জানেন। কখন কাকে বল দিতে হয়, কীভাবে ফিল্ডিং সাজাতে হয়, তাও জানেন। সবমিলিয়ে রাজ্যের নেতৃত্বেও বেমানান হবেন না।
এবারও বোর্ড সভাপতি হওয়ার আগে দিল্লিতে অনেক কিছুই ঘটেছে। অমিত শাহর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের কথা কারও অজানা নেই। সেই মিটিংয়ে কী আলোচনা হয়েছিল, কোনওপক্ষই প্রকাশ্যে বলেননি। বলার কথাও নয়। তবে, এটুকু বলা যায়, সেই আলোচনা মোটেই ক্রিকেটীয় ছিল না। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা বা বাংলাদেশের ইলিশ নিয়েও নিশ্চয় আলোচনা হয়নি। কিটসের কবিতা বা রোডোডেন্ড্রনের শোভা নিয়েও আলোচনা হয়নি। সৌরভ অনেক কিছু বুঝলেও, অমিত শাহ একটা জিনিসই বোঝেন। রাজনীতি। তোমাকে সভাপতি করছি, এতে আমার কী লাভ? তুমি আমাদের কী দেবে? শোনা যায়, সরাসরি এরকম প্রশ্ন নাকি উড়ে এসেছিল সৌরভের কাছে। সেই বলটা সৌরভ কীভাবে খেলেছেন? এটুকু নিশ্চিত, স্টেপ আউট করে ছক্কা মারেননি। দুরন্ত কভার ড্রাইভে মাঠের বাইরে পাঠাননি। হয় পা বাড়িয়ে ছেড়েছেন, নইলে আলতো ডাক করে বলটা নামিয়েছেন। পরের বলের জন্য স্টান্স নিচ্ছেন।
সৌরভ যদি রাজি হন, তাহলে কথায় কথায় বিজেপি রাজ্য অফিস মুরলিধর লেনের ইশারায় চলবেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এলে, পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়েই আসবেন। সরাসরি হটলাইন থাকবে মোদি–অমিত শাহদের সঙ্গে। রাজ্য নেতাদের সেভাবে পাত্তাই দেবেন না। বা দিলেও নিজের মতো করে ব্যবহার করবেন। নিজের টিম নিজে তৈরি করে নেবেন। যারা বাগড়া দিতে পারেন, তাঁদের কাউকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেবেন, কাউকে ছোটখাটো রাজ্যের রাজ্যপাল করে দেবেন। কাউকে হয়ত টোগো বা উগান্ডার রাষ্ট্রদূত করার সুপারিশ করবেন। মোদি–শা জুটি সেইসব দাবি মেনেও নেবেন। ক্যাপ্টেন থাকার সময় ডালমিয়ার সঙ্গে নাকি বরাবরই তাঁর হটলাইন যোগাযোগ ছিল। ক্রিকেট সার্কিটে একটা চালু কথা ছিল, সৌরভ যখন তখন জিরো থ্রি থ্রি ডায়াল করে ফেলেন। অর্থাৎ, কিছু হলেই ডালমিয়াকে ফোন করে বসবেন। তারপর নির্বাচক বা ম্যানেজারের চাকরি বাঁচানো মুশকিল। যিনি ম্যাকগ্রা, আক্রাম, শোয়েবদের সামলেছেন, যিনি ডালমিয়া–শরদ পাওয়ারদের সামলেছেন, তাঁর পক্ষে দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহাদের সামলানো অনেকটা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে রনজি খেলার মতোই।
শোনা যায়, সৌরভ নাকি তাঁর মতো করে সমীক্ষা চালিয়েছেন। এই রাজ্যে বিজেপির আসার সম্ভাবনা কতটা। মোদ্দা কথা, আব্দুল মান্নানের মতো বিরোধী দলনেতা হওয়ার জন্য তিনি আসবেন না। তিনি এলে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়েই আসবেন। তিনি এলে কাশ্মীর, হিন্দু, পাকিস্তান, রামমন্দির নিয়ে মাতামাতি করবেন না। বিজেপির অ্যাজেন্ডা যাই থাক, তাঁর অ্যাজেন্ডায় সেগুলো জায়গা পাবে না। তিনি জানেন, কীভাবে শিল্প আনতে হয়। কীভাবে কর্মসংস্থানের দরজা খুলতে হয়। কীভাবে রাজ্যবাসীর আস্থা অর্জন করতে হয়। অন্তত বিজেপির অন্যান্য নেতাদের থেকে ঢের ভাল জানেন।
তাই, সবমিলিয়ে আগামী পাঁচ–ছমাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৌরভ নিজেও জানেন, এমন সুবর্ণ সুযোগ আর নাও আসতে পারে। মমতার ভাষায়, এবার নয় নেভার। তাই, ঝাঁপালে এবারই ঝাঁপাতে হবে। কঠিন চ্যালেঞ্জ শুনে পিছিয়ে যাওয়ার বান্দা তিনি নন। মাঠ বা টিভির দাদাগিরি অনেকেই দেখেছেন। কে বলতে পারে, এবার সেই দাদাগিরি নবান্নে দেখা যাবে না!
***
বেঙ্গল টাইমসের পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত।
ই ম্যাগাজিনটি পড়তে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।