শান্ত মুখে কহে সাধু, “যে বৎসর বহ্নিদাহে দীন
বিংশতি সহস্র প্রজা গৃহহীন, অন্নবস্ত্রহীন
দাঁড়াইল দ্বারে তব, কেঁদে গেল ব্যর্থ প্রার্থনায়
অরণ্যে, গুহার গর্ভে, পথপ্রান্তে তরুর ছায়ায়,
অশ্বত্থবিদীর্ণ জীর্ণ মন্দিরপ্রাঙ্গণে, সে বৎসর
বিংশ লক্ষ মুদ্রা দিয়া রচি তব স্বর্ণদীপ্ত ঘর
দেবতারে সমর্পিলে।”
সেদিন টিভি চ্যানেলে অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপুজো দেখতে দেখতে ১২০ বছর আগের লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “দীনদান” কবিতার এই লাইন গুলো বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল। কতটা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন রবিঠাকুর! তাঁর সময়ের থেকেও তিনি কতটা এগিয়ে ছিলেন, ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে তার প্রমাণ পাই। ৬ আগষ্ট যেন নতুন করে দেখা গেল। তার ঠিক দুদিন পরে অর্থাৎ আজ রবি ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। তাই আজ আরেকবার তাঁকে স্মরণ করেই এই প্রতিবেদন।
আসলে ‘দীনদান’ কবিতায় বর্ণিত রাজার সঙ্গে আমাদের বর্তমান ভারতবর্ষের শাসক দলের একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য। সেখানে রাজা তাঁর রাজ্যের প্রজ়াদের অগ্নিদাহে আশ্রয় না দিয়ে কুড়ি লক্ষ টাকা দিয়ে আকাশছোঁয়া এক রত্নখচিত মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। রাজ্যের দরিদ্র প্রজারা অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন হয়ে তাঁর দোরে হাজির হলেও তিনি তাঁদের চরম দুর্দশাতে দৃকপাত করেননি। অসহায় প্রজারা অরণ্যে, গুহায়, গাছের নীচে, জরাজীর্ণ মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তেমনি বর্তমান ভারতবর্ষেও চিত্রটা প্রায় একই। এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে ভারতের অবস্থা বিগত কয়েক বছরে খুবই করুণ। ক্ষুধার সূচক ১০২ তে পৌঁছেছে। সীমাহীন দারিদ্র্য আর বেকারত্ব ছেয়ে ফেলেছে ১৩০ কোটি জনসমুদ্রের এই দেশকে। তার ওপর করোনা ভাইরাসের অস্বাভাবিক প্রকোপ। দেশের জনসাধারণ আজ সবদিক দিয়েই বিপর্যস্ত। প্রতিদিনি আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে উন্নতমানের হাসপাতালের সংখ্যা সীমিত। সুবিশাল দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় রোগ নির্ণয় করার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে। সেই কঠিন সময়ে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কর্মসূচি আকাশচুম্বী ‘রামমন্দির’ নির্মাণ। তার ভূমিপুজো হল রুপোর ইঁট দিয়ে। তাকে ঘিরে মহাযজ্ঞ, উদ্যোগ, আয়োজন অযোধ্যার বুকে। সেই জনপদে চারিদিকে আলোর রোশনাই, উৎসব—এককথায় বিলাসবৈভবের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
‘দীনদান’ কবিতায় রবি ঠাকুরের ভাষায় ‘রাজদম্ভে পূর্ণ’। আর সেই মন্দিরে অধিষ্ঠান কার ? রামায়ণে বর্ণিত রামচন্দ্রের? কখনই না। আজও অনেক বইয়ে বা বহু সাহিত্যিকের লেখায় একটা উপমা পাওয়া যায়। ‘সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই’। অর্থাৎ রামচন্দ্রের অযোধ্যা কাল্পনিক হলেও রামায়ণে বর্ণিত সেই রাজ্যে প্রজারা সুখে, শান্তিতে, স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। আর এই ভারতবর্ষে ? দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতপাতের বিভেদ, হিংসা এবং রক্তপাত। সর্বোপরি মহামারীর করাল থাবা। এই ভারত কি কোনওভাবে রামায়ণে বর্ণিত ‘রামরাজ্য’ এর সঙ্গে তুলনীয়? তাই বর্তমান সময়ে ‘রামমন্দিরের প্রতিষ্ঠা’ আসলে কেন্দ্রের সরকারের ধনতান্ত্রিক আচরণ, বিলাসবৈভব প্রদর্শন এবং দেশের জনসাধারণের দৃষ্টিকে সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা যেমন দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক শোষণ, এসব থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। ঠিক যেমন রবি ঠাকুরের কবিতায় ‘সে মন্দিরে দেব নাই..আপনারে স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে’।
গতবছর নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে ‘রামমন্দির’ নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়েছিল। আর মুসলিমদের দেওয়া হয়েছিল তার অনতিদূরে ৫ একর জমি। যুক্তি ও বিজ্ঞানমনষ্কতার নিরিখে এই রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সম্মান জানিয়ে রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতাও করছি না। কিন্তু বর্তমান ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বারবার রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনগুলোর আশ্চর্য প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। দেশের জনসাধারণ আর্থিকভাবে চরম বিপর্যস্ত। লকডাউণের ফলে হাজার–হাজার ছেলে–মেয়ে, যুবক–যুবতী কর্মহীন। বহু ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প বা কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সংগঠিত বা অসংগঠিত শ্রমিকের মজুরি নেই। গৃহ-পরিচারিকার বেতন নেই। কৃষকের ফসলের দাম পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের বেকারত্ব আকাশছোঁয়া। আর অর্থনীতির বাজারের এই ভগ্নদশায় চাকরি নেই। বরং কেন্দ্রের সরকারের তরফ থেকে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ক্রমশ বর্ধমান। পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কমানোর কোনও উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। তার ওপর ব্যাঙ্কে জমা টাকার ওপর সুদের হার কমানো, নির্দিষ্ট জমা পুঁজ়িতে সুদের হার কমিয়ে, ট্যাক্সের বোঝা বাড়িয়ে, জি.এস.টি ধার্য করে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তের শোষণ অব্যাহত। তার ওপর করোনা রোগে সীমাহীন আক্রান্ত এবং অহরহ মৃত্যুমিছিল। সরকারের তরফে সেই রোগ প্রতিরোধের কোনও সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেই। হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়নের কোনও চেষ্টা বা সদিচ্ছা নেই। এই ভয়াবহ সংক্রামক রোগের সংক্রমণ থেকে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রতিকার নেই। আর সেই নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে রামচন্দ্রের ভাবশিষ্য ভেবে, সাধক ভেবে দেশের রাজধানী থেকে অযোধ্যায় চলে যান রামমন্দিরের ভূমিপুজো করতে। তাঁকে তো বিগত চার মাসে কোনও হাসপাতালের উদ্বোধন করতে দেখা যায়নি। জমি নিয়ে আর জটিলতা এই, বেহাত হওয়ার আশঙ্কা নেই। ট্রাস্টেরি মালিকানা থাকছে। তাহলে, এই চরম দুঃসময়ে মন্দির নির্মাণ স্থগিত রাখা যেত না? এত ঘটা করে উদ্বোধনের কোনও দরকার ছিল? কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাঁর পরিবারের সবাইকে পাঠানো হচ্ছে কোয়ারেন্টিনে। অথচ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আক্রান্ত হলেও প্রধানমন্ত্রী দিব্যি গলা চড়িয়ে বক্তৃতা করে গেলেন। কাজের কাজ যখন করতে পারিনি, তখন রামমন্দিরের কৃতিত্বটাই নেওয়া যাক। নিজেই নিজের ঢাক পেটাও যাক।
রবি ঠাকুরের কবিতার শেষ পংক্তির সঙ্গেও কি আশ্চর্য মিল বর্তমান সরকারের প্রতিনিধি বা সমর্থকদের। সেখানে সাধু নরোত্তমকে ক্রুদ্ধ রাজা বলছেন, ‘ভণ্ড পামর, মোর রাজ্য ত্যাগ করে এ মুহূর্তে চলি যাও।’
দেশের এই দারুণ দুর্দিনে ‘রামমন্দির’ নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই জবাব আসছে, ‘দেশদ্রোহী। হিন্দুত্বের কলঙ্ক। ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাও পাকিস্তান বা অন্য কোনও দেশে!’ কী অসাধারণ দূরদর্শিতা বিশ্বকবির! তিনি বিলক্ষণ জানেন, স্বৈরাচার সময়ের দাবি মানে না। কোনওদিনই মানেনি। জার্মানিতে না, ইতালিতে না, কোথাও না। স্বৈরাচার সর্বদা তার আগ্রাসী নীতিতেই চলে। কিন্তু সেই কবিই বলে গেছেন, ‘শূন্যপানে চাই। আজ তার কোনও চিহ্ন নাই। জানি তারও পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল/ কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশ বেড়াজাল।’ তাই ভরসা হয়। এই আস্ফালন একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই জায়গা পাবে।
(ওপেন ফোরাম। বেঙ্গল টাইমসের বিশেষ জনপ্রিয় একটি বিভাগ। এখানে সমকালীন নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। সুস্থ বিতর্ক হয়। যুক্তি–পাল্টা যুক্তির লড়াই হবে। তবে, সবই গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার মেনে। চাইলে, আপনিও আপনার মতামত পাঠাতে পারেন। ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com)