শোভন চন্দ
আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই তাঁর বেড়ে ওঠা। তবে সময় যেন তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে, করে তুলেছে অনন্যা। একটু মজা করে বলতে গেলে, বাংলা সাহিত্যের রান্না ঘরে ইনি পাকা রাঁধুনি, পরম যত্নে-স্নেহে একের পর এক উপহার আমাদের দিয়ে গেছেন। তৎকালীন সমাজের প্রতিবন্ধকতাকে ছিন্ন করে সাহিত্যকে দিয়েছেন তাঁর অনন্য সৃষ্টি, বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজকে তাঁর লেখনীগুণে করেছেন সমৃদ্ধ। তবে কেমন ছিলেন গৃহিনী আশাপূর্ণা, কেমন ছিলেন সবার প্রিয় মাসিমা আশাপূর্ণা দেবী, সেই অজানা -অদেখা স্মৃতিচারণে নানা মজার কথা তুলে ধরলেন আমাদের সকলের প্রিয় ভানুবাবু (সবীতেন্দ্রনাথ রায়)।
আশাপূর্ণা দেবীর সান্নিধ্যে যখন প্রথম যাই তখন আমি নিতান্তই তরুণ, সবে প্রকাশনার কাজে ঢুকেছি। সে সময়ে তাঁর উপন্যাস ‘বলয়গ্রাস’ ছাপা হচ্ছে। এটি কোনও পত্র-পত্রিকায় বেরোয়নি। আশাপূর্ণা দেবী সরাসরি পাণ্ডুলিপি লিখে দিচ্ছিলেন কিস্তিতে- কিস্তিতে। আমি আনতে গেলাম সম্ভবত তৃতীয় কিস্তি। আমরা দরজায় যেতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে আমাদের বসাল, আমরা বসবার পর মেয়েটি জলখাবার দিয়ে গেল। বলল একটু বসুন, মা ঠাকুমাকে খাইয়ে আসছেন।
কিছুক্ষণ বাদে আশাপূর্ণা দেবী এলেন। হাতে সুন্দর লাইন টানা পাণ্ডুলিপি। সত্যি বলতে আশাপূর্ণা দেবীর সাথে এক মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আশাপূর্ণা দেবী ও কালিদাস গুপ্ত একরকম আমাদের মাসিমা মেসোমশাই ছিলেন, আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ি ছিল প্রথমে দর্জিপাড়ায়, উত্তর কলকাতায়। একান্নবর্তী পরিবার সেকালের কট্টর রক্ষণশীলতার মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলেন আশাপূর্ণারা। ঠাকুমা ছিলেন কর্ত্রী। তাঁর কড়া হুকুম- বাড়ির মেয়েরা গৃহকর্ম শিখবে শুধু, লেখাপড়ার ধারেকাছে যাবে না। দাদারা পড়তেন গৃহশিক্ষকের কাছে। দাদারা তখন সদ্য স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ লিখতে শিখেছেন। আশাপূর্ণা উল্টো দিকে বসে থাকতেন দাদাদের পড়াশুনো লক্ষ্য করতেন। তাই দেখে আশাপূর্ণা শেখেন লিখতে, কিন্তু সব উল্টোভাবে, যেহেতু উল্টোদিকে বসে লিখতেন। মেয়ের লেখাপড়ার উৎসাহ দেখে মা রাতে শোওয়ার সময়ে আয়নায় উল্টো লেখা দেখিয়ে কীভাবে সোজা লিখতে হয় তা শেখালেন। শুরু হল মায়ের কাছে বই পড়া ও লেখার প্রথম পাঠ। বাবা হরেন্দ্রকুমার ছিলেন শিল্পী। মা –বাবার শিল্পী মানসিকতার প্রভাবে এইভাবে আশাপূর্ণা সাহিত্যপাঠের জগতে প্রবেশ করলেন। সত্যি বলতে, এক চরম দুঃসাহসে কবিতা লিখে ফেললেন আশাপূর্ণা, নাম দিলেন – ‘বাইরের ডাক’। কিছুদিন পরে কবিতাটি শিশুসাথী পত্রিকাতে প্রকাশিত হল।
তখনকার প্রথামতো আশাপূর্ণা দেবীর বিয়ে হয়ে যায় অল্প বয়সেই , বছর পনেরো তখন তিনি। শ্বশুরবাড়ি সেকালের রক্ষণশীল পরিবার। তখনকার রক্ষণশীল পরিবারে, সমাজে কোন মহিলা লিখছেন এবং সেই লেখা পত্র- পত্রিকায় বেরোচ্ছে কেউ ভাবতে পারত না। কালিদাসবাবু নিজেই ব্যবস্থা করে দেন, যাতে পত্নী রাত্রে হ্যারিকেনের আলোয় লিখতে পারেন। কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখতে লন্ঠন, যাতে আলো বাইরে না যায়। লেখা হলে নিজেই পৌঁছে দিতেন পত্র- পত্রিকাতে।
একদিন আশাপূর্ণা দেবী রাতে আমায় ফোন করলেন, ভানু , তোমার মেশোমসাই ও আমি কাল দুপুর বারোটার ট্রেনে শ্বশুরবাড়ি যাব। তুমি কষ্ট করে দুটো বই –একটা “বলয়গ্রাস” আর একটা “নির্জন পৃথিবী” কৃষ্ণনগরের ট্রেনে পৌঁছে দেবে । তাহলে আমার শ্বশুর বাড়িতে মুখ রক্ষে হয়। আমরা ১২ টার ট্রেনে যাব।
সেই মত পৌঁছে দিয়ে বললাম, মাসিমা এবার তাহলে ধারাবাহিকটা শুরু করা যাক মাসিমা হেসে বললেন সামনের মাস থেকে দেব ,প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি । আমি বললাম তাহলে নামটা দিন আগে থেকে বিজ্ঞাপন করতে হবে তো। উনি বললেন ওই প্রতিশ্রুতি দাও না না বরং “প্রথম প্রতিশ্রুতি” দাও । সেই “প্রথম প্রতিশ্রুতি” উপন্যাসের ভিত্তিস্থাপন । ১৩৬৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যা থেকে প্রথম প্রতিশ্রুতি ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে ।
জন্মদিনে রাধাবল্লভী, দরবেশ চমচমের সঙ্গে আশাপূর্না দেবীর নিজের হাতে ভাজা বেগুনী অন্যতম চিত্তাকর্ষক খাবার ছিল। বড় সুখের দিন ছিল। “প্রথম প্রতিশ্রুতি” উপন্যাস “রবীন্দ্র- পুরস্কার” পেল । ১৯৭৭ সালে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেল। সংসারে অবিমিশ্র সুখ বা দুঃখ হয় না, জ্ঞানপীঠ ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ল কালিদাস বাবুর কঠিন ব্যাধি – ক্যান্সার। তার বয়স ও স্বাস্থ্য বন্ধু প্রিয়জনদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠল, পুরস্কার হাতে নেওয়ার সময় কালিদাস বাবু সুস্থ থাকবেন তো? আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে যেতে পারবেন তো ? বন্ধু বান্ধবরা ঠিক করলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রদানের আগেই কলকাতায় মহাবোধি সোস্যাইটি হলে আশাপূর্ণা দেবীকে এই উপলক্ষ্যে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। গুণমুগ্ধ সাহিত্যিক সাহিত্যমোদীদের আন্তরিকতায় সে সংবর্ধনা সভাটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
কালিদাসবাবু চলে যান ১৯৭৮ খ্রীঃ ১৮ই মার্চ। আশাপূর্ণা দেবী জ্ঞানপীঠ পুরস্কার নিতে যাওয়ার আগেই কালিদাস বিদায় নেন। অবশ্য কালিদাস বাবু বিয়ের দিন থেকেই আশাপূর্ণা দেবীর ব্যক্তি স্বত্বা সাহিত্যিক স্বত্বা উভয়কেই আগলে রাখতেন। “দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে” উপন্যাসে এই পত্নিকে আগলে রাখার একটি আভাস পাওয়া যায় । প্রায় সুস্থ থাকার শেষ দিন পর্যন্ত আশাপূর্ণা কলম চালনা করেছেন তারপর কলম চালনা আর অন্ন গ্রহণ এক সঙ্গে থেমেছে । ১৯৯৫ খ্রীঃ ১৩ ই জুলাই তিনি পরপারে যাত্রা করেছেন, তবে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি আজও থেকে গেছে…