দুয়ারে কড়া নাড়ছে শীত। সামনেই আসছে বড়দিনের ছুটি। হাতে আর তেমন লম্বা ছুটি নেই। চিন্তা করবেন না। হাতের কাছেই রয়েছে অসংখ্য জায়গা। দু তিন দিন ঘুরে আসুন। মন ভাল হয়ে যাবে।
গাদিয়ারা
হুগলি, রূপনারায়ণ, দামোদর— এই তিন নদীর ত্রিবেনী সঙ্গম গাদিয়ারা। রূপনারায়ণ হুগলি নদীতে মিশে রূপ নিয়েছে সমুদ্রের। চড়ুইভাতির জন্য আদর্শ জায়গা গাদিয়ারা। শীত প্রায় এসেই গেল। এর মধ্যেই পিকনিকের লোকজন খোঁজ নিতে শুরু করে দিয়েছেন। মোটর বোট নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় মায়াচর, গেঁওখালি। কিংবা কাছেই গড়চুমুকে। হাওড়া থেকে ৭৮ কিমি দূরের গাদিয়ারা যেতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা। ধর্মতলা থেকে সারাদিন সি টিসি বাস পাওয়া যায়। ব্রেক জার্নি করতে হলে বাসে নরপুর চলে যান, সেখান থেকে লঞ্চে গাদিয়ারা। বাগনান, উলুবেড়িয়া হয়েও যাওয়া যায় গাদিয়ারায়। থাকার জন্য আছে নানা রিসর্ট। পর্যটন দপ্তরের অতিথিশালাটিও নদীর কাছেই। খরচ একটু বেশি। তবে খারাপ লাগবে না। রাতে নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। রূপনারায়ন ট্যুরিস্ট লজ — (ডব্লু বি টি ডি সি) — ০৩২১৪ ২৬৩১২৫
কামারপুকুর
শান্তিতে দুদিন কাটাতে চান? কোনও ধর্মীয় স্থানে? একান্তে ঠাকুরের নাম কবে? তিন ঘন্টা দূরেই রয়েছে কামারপুকুর। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মস্থান। ধর্মতলা ও হাওড়া থেকে আছে সরাসরি বাস। সময় লাগে তিন ঘন্টা। এছাড়া বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া, দুর্গাপুর বা আরামবাগ থেকেও পেয়ে যাবেন অনেক বাস। চাইলে ট্রেনে করে চলে যান বর্ধমান, তারকেশ্বর, কিংবা বিষ্ণুপুর। এখান থেকে বাস, বা গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। রামকৃষ্ণ স্মৃতি মন্দির, যোগীমন্দির, ঠাকুরের বসতবাড়ি, এছাড়াও আছে কুলদেবতা। রঘুবীরের মন্দির এবং ঠাকুরের হাতে লাগানো আমগাছ। মন্দির ঘুরে যেতে পারেন লাহাবাবুদের পাঠশালা, যতীনাথ পাইনের বাড়ি, গোপেশ্বর শিবমন্দির, ঠাকুরের হালদারপুকুর ও ঠাকুরের ভিক্ষামাতা কামারানাদেবীর বাড়িও। মন্দির খোলা থাকে ভোর ৬–৩০ থেকে বেলা ১১–৩০। বিকেল ৩–৩০ থেকে রাত ৮–৩০ পর্যন্ত। ভোর চারটের মহারতি খুবই উপভোগ্য। ফাল্গুন মাসে কামারপুকুরে ঠাকুরের আবির্ভাব তিথিতে পনেরো দিনের মেলা বসে। কাছেই রাজা রামমোহন রায়ের জন্মস্থান রাধানগর। থাকার জন্য আছে জেলা পরিষদ লজ। কামারপুকুর ট্যুরিস্ট লজ, শ্রীরামকৃষ্ণমঠের নিজস্ব গেস্ট হাউস (ফোন নম্বর— ০২৩১১ ২৪৪২২১)। জয়রামবাটি কামারপুকুর থেকে সামান্য পশ্চিমে গেলেই পাবেন জয়রামবাটি। এটি অবশ্য হুগলি নয়, বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত। আমোদর নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম, সারদা মায়ের জন্মভূমি। তাঁর স্মৃতিমন্দিরে আছে তাঁর মর্মর মূর্তি। মাতৃমন্দিরের কাছেই মায়ের পুরনো ভিটে, খড়ের চাল ও নিকোনো উঠোন সজ্জিত। এছাড়া বাড়ির লাগোয়া পুনিং পুকুরের পাড়ে কুলদেবতা সুন্দরনারায়ণ, শীতলামন্দির, বসার ঘর, পাকশালা। বাসস্ট্যান্ডের কাছে আছে বিশালাকায় দীঘি। আর সেই বাড়ি, যেখানে জীবনের শেষ চারবছর কাটিয়েছিলেন সারদা মা। জয়রামবাটি থেকে ২ কিমি দূরেই শিহড় গ্রাম। শান্তিনাথ শিবের মন্দির দেখার মতো। এছাড়া আছে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগ্নে হৃদয়ের ভিটে। কলকাতা ও হাওড়া থেকে সারাদিন বাস পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের প্যাকেজ ট্যুরে বেরিয়ে পড়তে পারেন। থাকার জন্য আছে মাতৃমন্দির, যাত্রীনিবাস। ফোন— ০৩২১১ ২৪৪২২২
বিষ্ণুপুর
বাংলার ইতিহাসকে চাক্ষুস করতে হলে ঘুরে আসতে পারেন মল্ল রাজাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর। চতুর্দশ ও ষোড়শ শতকে নির্মিত পোড়া মাটি ও ল্যাটেরাইট দিয়ে তৈরি মন্দিরের অলঙ্করণ পর্যটকদের মুগ্ধ করে। টেরাকোটা শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ বিষ্ণুপুরে বিখ্যাত মন্দিরগুলির মধ্যে আছে মদনমোহন মন্দির, জোড়াবাংলা মন্দির, পাঁচচূড়ার শ্যাম মন্দির, একচূড়ার রাধেশ্যাম মন্দির, চতুষ্কোন চূড়ার মালেশ্বর মন্দির, মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার নকশা, দেবদেবীর আখ্যান, রাসমন্দির। পাথরের তোরনের ভেতর দেখতে পাবেন রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ। লালবাঁধের পথে অষ্টাদশ শতকের সৃষ্ট চার মিটার দীর্ঘ দলমাদল কামান। বিষ্ণুপুরে যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তিভবন ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে একবার ঢু মারতে পারেন। লালবাঈ প্রেমের কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুরে আসতে পারেন শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন ও দেবী সর্বমঙ্গলা ও দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির। সঙ্গীতের একটা ঘরানা তো আছেই। সেই যদুভট্টের বাড়ি কিন্তু এই শহরেই। হাওড়া থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, রূপসী বাংলা, আরণ্যক, রাজ্যরানী, হাওড়া–চক্রধরপুর প্যাসেঞ্চারে চলে যেতে পারেন বিষ্ণুপুর। ধর্মতলা থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় আছে সরকারি, বেসরকারি বাস। ছোট্ট শহরটিকে রিক্সাভাড়া করেই তিন চার ঘন্টায় দেখে নেওয়া যায়। সরকারি, বেসরকারি অসংখ্য লজ আছে থাকার জন্য। বিষ্ণুপুর ট্যুরিস্ট লজ — ০৩২৪৪ ২৫২০১৩ ২৫৩৫৬১। মিউনিসিপ্যালিটি গেস্ট হাউস — ০৩২৪৪ ২৫২২০০। বিষ্ণুপুর লজ — ২৫২০১৩। হোটেল মেঘমল্লার — ২৫২ ২৫৮।
দুয়ারসিনি
কয়েকবছর আগেও দুয়ারসিনি বললেই একটা আতঙ্ক তাড়া করত। সুন্দর একটি অতিথি নিবাসকে ডিনামাইড দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। সেই আতঙ্কে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কের রেশ কাটিয়ে নতুন করে জেগে উঠছে দুয়ারসিনি। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। গা ছমছম করা এক অনুভূতি। ভয়ঙ্কর, একইসঙ্গ রোমাঞ্চে ভরা। সাঁওতাল, মুন্ডা, শবর এসব আদিবাসীদের সংস্কৃতির ক্ষেত্র দুয়ারসিনি। দেবতার ঘর দুয়ারসিনির সৌন্দর্য মনে দাগ কেটে যায়। প্রায় ৩০০ হেক্টরের জঙ্গলের মধ্যে বহমান সাতগুরুং নদী শালসেগুনে ছাওয়া ছোট ছোট টিলা মনে অপূর্ব শান্তি দেয়। প্যাঙ্গোলিন, নেকড়ে, হায়না এমনকি দেখা পাওয়া যেতে পারে দুমকার হাতির পালও। হিলটপ ও ১৫৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত মনোরম উদ্যানে জিরিয়ে নিতে পারেন নিশ্চিন্তে। ঘাটশিলা থেকে ২১ কিমি। গালুডি থেকে ১৩ কিমি। পুরুলিয়া থেকে ৭২ কিমি দূরে আদিবাসীদের ভূমি এই দুয়ারসিনিতে থাকার জন্য আছে সরকারি লজ, ইকো ট্যুরিজম সেন্টার। দুয়ারসিনি যাওয়ার সবথেকে সহজ রাস্তা রেলপথ। হাওড়া থেকে চলে যান ঘাটশিশা। সেখান থেকে জিপে বা অটোতে দুয়ারসিনি। পুরুলিয়া বা বান্দোয়ানে গিয়ে সেখান থেকেও জিপে করে দুয়ারসিনি যাওয়া যায়।
পারমাদান
নামটা অচেনা ঠেকছে? আসলে, ইছামতির তীরে এই অভয়ারণ্যের নতুন নাম বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণালয়। ৬৪ হেক্টরের এই নতুন বনাঞ্চলে প্রায় তিনশোর বেশি হরিণ আছে। চাঁদনি রাতে ইছামতির বুকে নৌকা বা ভুটভুটিতে বসে উপভোগ করা যায় জঙ্গলের সৌন্দর্য। পারমাদার ডিয়ার পার্কে বাঁশ, তুঁত, অর্জুন, শিমুল, সিরিশের ফাঁকে চোখে পড়বে শঙ্খচিল, ফুলটুসির মতো হরেক অচেনা, অজানা পাখি। আছে শিশু উদ্যান, চিড়িয়াখানা। রবিবার সকালে চড়ুইভাতির জন্য আদর্শ জায়গা এই পারমাদান। নদীয়ার পথে নলুডুংরি পেরিয়ে ইছামতির তীরে এই পারমাদান ডিয়ারপার্ক। শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চলে যান বনগাঁ। সেখান থেকে রিক্সায় মোতিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড। তারপর দত্তফুলিয়ার বাসে চলে যান নলুডুংরি। এছাড়া শহীদ মিনার থেকে পাবেন সরকারি, বেসরকারি অনেক বাস। বারাসত, বনগাঁ হয়ে চলে যান নুলডুংরি। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বা ভ্যান রিক্সায় পারমাদান মাত্র তিন কিলোমিটার। বনবিভাগের নিজস্ব ট্যুরিস্ট বাংলোয় বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। বুকিং ডি এফ ও, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা। ফোন— ২৫৫২ ০৯৬৮ বেথুয়াডহরি বাড়ির কাছে এক দুদিনের ছুটিতে জঙ্গল ভ্রমণ করতে ইচ্ছে করলে ঢু মারতে পারেন বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্যে। হরিনখ্যাত বেথুয়াডহরি অরণ্যে রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচশো হরিন। কৃষ্ণনগর থেকে ২৮ কিমি দূরে এই অভয়ারণ্য খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত। হরিন ছাড়াও চোখে পড়বে বনবিড়াল, খরগোশ। সেগুন, শিরিশ, বাবলা, মেহগনিসমৃদ্ধ ১৬৫ একরের এই জঙ্গলে থাকার জন্য আছে দুটি ফরেস্ট হাউস। গেস্ট হাউস থেকেই চোখে পড়বে হরিনের আনাগোনা। কলকাতায় বিকাশভবনে বন উন্নয়ন নিগমে বুকিং করতে পারেন। কৃষ্ণনগর থেকেও বুকিং করা যায়। ফোন — ০৩৪৭৭ ২৫২৩৬২। শিয়ালদা থেকে বহরমপুর দিকে যাওয়ার ট্রেনে উঠে পড়ুন। নেমে যান বেথুয়ায়। স্টেশন থেকে কাছেই, রিক্সা ধরে নিন। বাসে গেলে একেবারে অভয়ারণ্যের মুখেই নামতে পারেন।