Categories Uncategorized

নিশীথ সূর্যের দেশ এখন শীতঘুমে

পৃথিবীর একেবারে উত্তর মেরুর একটা ছোট্ট দেশ নরওয়ে। যাকে আমরা নিশীথ সূর্যের দেশ বলে জানি। মানে মাঝরাত্রে সূর্যের আলো দেখা যায়। হ্যাঁ সত্যিই তাই। গত সাত বছর ধরে আমি নরওয়ের ওসলো শহরের বাসিন্দা। পেষায় জীবরসায়নের গবেষক। ওসলো বিশ্ববিদ্যালয় আমার কর্মস্থল।

মার্চের শুরুর দিকের কথা। করোনার প্রকোপে চিনের উহান শহর তখন জর্জরিত। চিনের প্রাচীর টপকে ইতিমধ্যে ইউরোপের কয়েকটা দেশেও থাবা বসিয়েছে ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাস। তখনও উত্তর ইউরোপীয়ো দেশগুলোতে তেমনভাবে তার প্রভাব ফেলতে পারে নি করোনা। তাই সাধারণ জীবনযাপনেই ব্যাস্ত ছিল মানুষ। দৈনন্দিন কাজকর্ম অফিস, আদালত আর সপ্তাহান্তে ঘোরাফেরা, খাওয়াদাওয়া আর হইহুল্লোড়, এভাবেই কাটতো। ওসলো শহরের জনসংখ্যা খুব একটা বেশী নয়। তাই ছুটির দিনগুলো ছাড়া রাস্তাঘাটে জনসমাগম প্রায় হাতে গোনা বললেই চলে। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতে গোটা শহরটাই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়।

নরওয়েতে প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান মিলল ফেব্রুয়ারী মাসের একেবারে শেষের দিকে, উত্তরের একটি ছোট্ট শহর ট্রমশোতে। ওসলো একেবারে দক্ষিণে। তাই শুধু করোনাই কেন, করোনার ভয়ও আমাদের তেমনভাবে গ্রাস করতে পারে নি। কিন্তু তখনও আমরা উপলব্ধি করতে পারি নি করোনার ভয়ঙ্করতা। আমারা অনেকেই করোনা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছি। সোশাল মিডিয়ায় নানান ধরনের মিম শেয়ার করেছি। এককথায় বেশ মজাতেই কাটছিল। ১২ মার্চ হটাৎ করে যেন সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো। নরওয়েতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক শ’ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের আনুমানিক সংখ্যার তুলনায় যা প্রায় দশ গুন বেশী। নড়েচড়ে বসল সরকার। আমাদেরও আনন্দ উৎসবের রেসটা যেন হটাৎ করে ফিকে হয়ে গেল। সবার চোখ তখন অনলাইন সংবাদপত্র বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। কি হতে চলেছে!

১২ মার্চ থেকে ১৪ দিনের লকডাউন ঘোষণা করলো সরকার। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, অফিস, আদালত সব বন্ধ। এমনকি বিমান পরিষেবাও। শুধু বাদ পড়লো ওষুধ দোকান, হাসপাতাল, সুপার মার্কেট আর অন্যান্য জরুরি পরিষেবা। সবার মুখেই তখন আতঙ্কের ছাপ। কিছুটা হলেও দিশেহারা। সোশাল মিডিয়ায় এতদিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় সুপারমার্কেটে টয়লেট পেপার কেনার তাড়াহুড়ো আর গুঁতোগুঁতি দেখে অনেক হাসাহাসি করেছি। এবার যেন আমাদের পালা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে সুপার মার্কেটগুলোতে। এতো ভিড় আগে কোনদিন চোখে পড়ে নি। রাশি রাশি জিনিপত্র কিনছে সবাই। মনে হল ১৪ দিন নয়, এ যেন ১৪ সপ্তাহের খাবার সঞ্চয়ের হুড়োহুড়ি। বুঝলাম এই দৌড়ে আমি অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। যথাযতভাবেই আমার ভাগে তেমন কিছুই জুটলো না। তাই ভাঙ্গা মেলায় যা যা পেলাম তাই উঠিয়ে নিলাম। বন্ধুরাও ফোনে জানালো তারাও আমার মতোই পেছনের সারিতে পড়ে গেছে।

নরওয়েতে দিন দিন বেড়েই চলেছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা, আর তার সিংহভাগটাই ওসলো শহরে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই বেশী। গোটা দেশের মানুষ ঘরবন্দি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এতো অগ্রগতির দিনেও যেন প্রকৃতির রোষানল দেখা দিয়েছে। করোনা নামক একটা আণুবীক্ষণিক জীব এই অতিকায় পৃথিবীটাকে যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। চুরমার করে দিচ্ছে মানব সভ্যতা ও অর্থনীতি। সারা পৃথিবীজুড়ে মানুষ আজ অসহায়। সামাজিক দূরত্ব, ঘরবন্দি, লকডাউন, কোয়ারেনটাইন- শুধু এই শব্দগুলোই মানুষের মস্তিষ্কে টোকা মারছে প্রতিমুহূর্তে।

নরওয়ে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করোনার মোকাবিলা করে যাচ্ছে। মানুষের স্বার্থে ইতিমধ্যেই অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যাবস্থা নিয়েছে এ দেশের সরকার। লক্ষাধিক মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকস্তরে সব রকমের ব্যাবসা বাণিজ্য বন্ধ। কোন এক অজানা অপরাধে আমরা সবাই যেন আজ খাঁচাবন্দি। স্কুলের পড়াশুনা চলছে অনলাইনে। শুরু হয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কর্মসূত্রে বেশীরভাগ সময়টাই আমাকে গবেষণাগারে কাটাতে হয়, তাই আমার ক্ষেত্রে ওয়ার্ক ফ্রম হোম প্রযোজ্য নয়। সুপারমার্কেটগুলো বিশেষ ব্যাবস্থা নিয়েছে বয়স্ক লোকেদের জন্য। কোনো কোনো জায়গায় তাঁদের জন্য আলাদা কাউণ্টার খোলা হয়েছে। আর যারা বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবেন না, তাঁদের জন্য হোম ডেলিভারির ব্যাবস্থা। কিছু ডে কেয়ার খোলা রাখা হয়েছে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের ছেলেমেয়েদের জন্য। আপদকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য অনেক মেডিক্যাল স্টুডেন্ট স্বেছায় হাসপাতালে যোগদান করেছে। গনপরিবহন নিয়মিত চলছে। কিন্তু বাস, ট্রাম বা মেট্রোতে তেমনভাবে কাউকে চোখে পড়ে না। সুনসান রাস্তাঘাট। শহরজুড়ে এক চরম নিস্তব্ধতা। সপ্তাহান্তে যে শহর মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে, ভরে ওঠে জনমানবের কলরব কোলাহলে, আজ সেই শহর চলে গেছে শীতঘুমে। এ এক নতুন ওসলো, যা আগে কোনদিন দেখি নি।

আমি, আমার স্ত্রী আর আমার আড়াই বছরের মেয়ে, সবাই এখন ঘরবন্দি। আরও কতদিন থাকতে হবে জানি না। যদিও নরওয়ের করোনা পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কিছু সপ্তাহের মধ্যে হয়তো আবার একটু একটু করে সাধারণ হতে শুরু করবে। তবে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। ঘরবন্দি জীবন যেন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তির দৌলতে বন্ধুদের সাথে ভারচুয়াল আড্ডাই এখন একমাত্র সম্বল। দেশের বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরাও ঘরবন্দি। মনের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে দুশ্চিন্তার করাল স্রোত। বাড়ির বাইরে পা রাখলেই মনের মধ্যে ভয় হয়। দোকান বাজার সবটাই তাই অনলাইনে। আশা করি, খুব শীঘ্রই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ তার সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরে আসবে। ওসলো শহর আবার তার চেনা মেজাজে ফিরে আসবে। সারা পৃথিবী করোনা মুক্ত হবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.