ডঃ অন্তরা চৌধুরি
শরতের মেঘ কেমন যেন স্মৃতিমেদুর করে তোলে। পুজো আসে, পুজো যায়, আড়ম্বরেও খামতি নেই। তবু রেশটা যেন নিমেষেই হারিয়ে যায়। খুব পুরনো কথা হয়ত মা–জেঠিমারা বলতে পারবেন। আমাদের সেই স্মৃতির ভাঁড়ার কোথায়! তবু, কয়েকবছর আগেও তো পুজোটা অন্যরকম ছিল। মাত্র কয়েক বছরেই ক্যানভাসের রঙটা কেমন দ্রুত বদলে গেল। পুজো আসছে— এই কথাটার সঙ্গে বাঙালির অনেক আবেগ জড়িয়ে ছিল। পুজো মানেই কাশফুল, নীল আকাশে সাদা মেঘ, শিউলি ফোটা ভোর, নতুন জামাকাপড়, পুজোর গান, পুজো সংখ্যা, পুজোর খাবার, আর পুজোর প্রেম। এইসব মিলিয়েই তো ছিল আমাদের দুর্গাপুজো।
সময়টা সেই তখন, যখন জেলাশহর বা মফস্বলে থিমপুজো শুরু হয়নি। ‘প্যান্ডেল হপিং’ শব্দ দুটো দুর্গাপুজোর ডিকশেনারিতে জায়গা পায়নি। কেয়া শেঠ বা সৌমিদি বঙ্গললনাদের সুন্দরী করতে উঠে পড়ে লাগেনি। হলদিরাম বা বাঞ্ছারাম বাঙালির মিষ্টির হাঁড়িতে থাবা বসায়নি। ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজন ঘরে ঘরে কাজু বরফি বা ‘বেসন কা লাড্ডু’ ডেলিভারি শুরু করেনি। পুজো এল মানেই সব বাড়িতে সাজো সাজো রব শুরু হয়ে গেল। ঘর ঝাড়া, রঙ করা দিয়ে শুরু হত। ছিল–নেই বা মিল–অমিলের তত্ত্ব থাক। দুর্গাপুজোর রচনা লিখতেও বসিনি। আমাদের আলোচনা বরং শুধু ভিয়েনে সীমাবদ্ধ রাখা যাক। জমিদার বাড়ির ভিয়েনের কথা নানা গল্প, উপন্যাস বা সিনেমায় আছে। আমরা বরং আমাদের অন্দরমহলের কথা বলি। সেইসময় প্রায় সব বাড়িতেই ছোটখাটো ভিয়েন বসত। আমাদের আড্ডা সেই পুরনো ও অধুনালুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রথাটিকে নিয়ে।
এখনকার মতো সেই সময় ফোন বা হোয়াটস্অ্যাপে বিজয়ার প্রণাম সারার ব্যাপারটা ছিল না। কাজেই সব বাড়িতেই আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি মিলিয়ে প্রচুর লোক আসত। রেডিমেড মিষ্টি দেওয়ার থেকে হাতে বানানো মিষ্টি খাওয়ানোতেই বাড়ির কাকিমা, জেঠিমাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল। হাঁটুর ব্যথা তখনও তাদের কাবু করতে পারেনি।
সেই সময় সকলের বাড়িতেই টানা মিঠাই বা টানা নাড়ু হত। অনেকের বাড়ির ট্রাডিশন ছিল যে বাড়ির তৈরি সেই মিঠাই মা দুর্গাকে ভোগ দেওয়া। বিশাল বড় কাঠের উনুনে একখানা মস্ত লোহার কড়াই চাপিয়ে তাতে তেল ফুটত। তার উপর একটা লোহার ছোট ছোট ফুটো করা জালতি থাকত। সেই জালতির ওপর দিয়ে জল দিয়ে শক্ত করা মাখা বেসন টানতে হত। তেলে ভাজা সেই অপূর্ব খাদ্যটির নাম ‘চোনা’ ওরফে ঝুরিভাজা। গুড়ের পাক করে তার মধ্যে সেই চোনা মেখে নাড়ু তৈরি করা হত। যারা তৈরি করত, গরম গুড়ের ভাপে তাদের হাত লাল হয়ে যেত। আবার কারও বাড়িতে হত বোঁদের মিঠাই ও চিনির মিঠাই। বাকি থাকা বেসনে নুন, লঙ্কাগুঁড়ো, জোয়ান দিয়ে ভাজা হত ঝালচোনা। বিজয়ার সময় যারা প্রণাম করতে আসত, বিভিন্ন বাড়িতে মিষ্টি খেয়ে তাদের মুখের স্বাদ হারিয়ে যেত। সেই স্বাদ ফিরিয়ে আনতে ঝালচোনা ছিল মোক্ষম দাওয়াই। তাছাড়া পুজোর রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার অনেক পরেও চায়ের সঙ্গে ‘টা’ হিসেবে দিব্যি চলত।
নারকেল নাড়ু আট থেকে আশি সকলেরই বেশ প্রিয় ছিল। এখনও আছে। কিন্তু জিরো ফিগারের চাপে অনেকেই সে কথা স্বীকার করে না। গুড় এবং চিনি এই দুই মিশিয়ে নারকেল নাড়ু হত। আরও একটা জিনিস বানানো হত, নারকেলের তক্তি। আবার দুধ, ক্ষীর, এলাচ আর নারকেল দিয়ে বানানো হত নারকেল সন্দেশ, যা এককথায় এখনকার ‘বুদ্ধিজীবী সন্দেশ’কে দশ গোল দিতে পারে।
আরেকটা জিনিস ছিল বড়ই লোভনীয়। সেটা হল গুড়পিঠে। যার স্থানীয় নাম ‘আড়ষা’। ভেজা চাল শিলে বেটে গুড়ের পাক করে তাতে মাখিয়ে চ্যাপ্ট চ্যাপ্টা করে গড়ে তেলে ভাজা হত। ওপর থেকে মনে হবে শক্ত, কিন্তু মুখে দিলেই নরম। এই চাল আর গুড়ের ব্যালান্স করাটা বেশ জটিল। সকলের দ্বারা হত না। এখানেই পাকা হাতের কদর। আবার ছানা বা ক্ষীরকে ছাঁচে ফেলেও ঘরোয়া সন্দেশ তৈরি করা হত। ময়দার সঙ্গে ডালডা ও চিনি মিশিয়ে তৈরি হত বালুসাই ও গজা। যা ছিল পরম লোভনীয়।
এ তো গেল মিষ্টির কথা। এবার একটু নোনতা কথায় আসা যাক। পুজোর সময় প্রায় সকলের বাড়িতেই তৈরি হত কাঠি নিমকি। এটা কচিকাঁচাদের কাছে ছিল বিশেষ প্রিয়। অনেকের বাড়িতে হত বিজয়া সম্মেলনী। সেদিন তৈরি হত ফুলকপির সিঙ্গাড়া, মাংসের ঘুগনি। তখনকার দিনে কচিকাঁচাদের খিদেটা অবশ্য একটু বেশিই ছিল। তাই তারা লুকিয়ে এসব খাবারের অনেকটাই ভ্যানিস করে দিত। কিন্তু ‘বাড়ির গিন্নি রুক্ষ মূর্তি বলে আর পারি নাকো’। তাই সব খাবার বোতলবন্দি করে একটা কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিত। হঠাৎ করে অতিথি এলে এইসব খাবারেই মুখরক্ষা হত। অধিকাংশ বাড়িতেই সেই সময়ে ফ্রিজ ছিল না। কাজেই, এমন সব খাবার তৈরি করা হত, যা অনায়াসেই কয়েক মাস রাখা যায়। আসলে, তখন বাড়ির কাকিমা–জেঠিমাদের জীবনে অঢেল সময় ছিল। সিরিয়াল নামক ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’টি তাদের দুপুর ও সন্ধেগুলো কেড়ে নেয়নি। অন্যদের খাইয়েই তারা আনন্দ পেত।
এই প্রজন্ম হয়ত ‘ভিয়েন’ শব্দটার সঙ্গেই পরিচিত নয়। হয়ত সবজান্তা গুগল হাতড়ে যাবে। শুধু মহানগর নয়, মফস্বল শহর থেকেও হারিয়ে যেতে বসেছে শব্দটা। শোনা যায়, ইদানীং ভিয়েনের কারিগরও নাকি পাওয়া যায় না। যে লোকটা মিঠাই বানাত, তার উত্তসূরী হয়ত চাউমিনের স্টল দিয়েছে বা হয়ত পিঠে জোমাটোর ইয়াব্বড় ব্যাগ নিয়ে ঘুরছে। বদলে যাওয়া সময়, বদলে যাওয়া খাবারের ভিড়ে সেই ভিয়েন কোথায় যেন হারিয়ে গেল!