লকডাউনে অনেকটা অক্সিজেন দিয়ে গেল মন্দারমণি

হেমন্ত রায়

টানা পাঁচ ছ মাস হয়ে গেল কোথাও যাওয়া হয়নি। এভাবে মাসের পর মাস বন্দি থাকতে কারও ভাল লাগে!‌

অনেক হয়েছে। এবার ভয় ভেঙে বেরোতেই হবে। যা হয় দেখা যাবে। এই ভেবেই ঠিক করলাম সমুদ্রে যাব।

এই বাংলায় সমুদ্র বলতে মূলত দুটো জেলা বোঝায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা আর পূর্ব মেদিনীপুর। আমার পছন্দ অবশ্যই দ্বিতীয়টা। কিন্তু সেখানেও নানা গন্তব্য। বাঙালির চিরন্তন দিঘা তো আছেই। সঙ্গে আছে শঙ্করপুর, তাজপুর, মন্দারমণি, বাঁকিপুট, জুনপুট।

সব জায়গাগুলোই ঘোরা। কেন জানি না, আমার সবথেকে বেশি ভাল লাগে মন্দারমণি। সমুদ্রকে এত কাছ থেকে আর কোথাও দেখা যায় না। অন্যান্য সব জায়গায় সমুদ্রে রাত নটা পর্যন্ত থাকো। তারপর বাঁশির আওয়াজ শুনে উঠে পড়ো। দশটা বাজার আগেই হোটেল বন্ধ।

mandarmoni6

বলুন তো, এত সুবোধ বালক হয়ে ঘুরতে যাওয়া যায়!‌

গাড়িতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। আমাদের ভরসা বাস। সঙ্গে নিলাম এক বন্ধু প্রসূনকে। সেও অনেকদিন ধরেই বাইরে যাওয়ার কথা বলছিল।

ধর্মতলা থেকে বাস। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। কোলাঘাটে কিছুক্ষণের বিরতি। এই বাসে আমাদের মতো আরও অন্তত জনা কুড়ি লোক ছিল। সবাই ঘুরতেই যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে অন্তত চার জোড়া দম্পতি। দুজন বৃদ্ধকেও দেখলাম। তাঁরাও নিখাদ ঘুরতেই যাচ্ছেন। অধিকাংশই অবশ্য দিঘা যাবেন। চাউলখোলায় নামলাম আমরা দুজনই।

চাউলখোলা থেকে টোটোয় মিনিট কুড়ির পথ। হোটেল বুকিং ছিল না। তবে ফাঁকা আছে কিনা বা থাকতে দিচ্ছে কিনা, ফোনে জেনে নিয়েছিলাম। আমরা উঠলাম মন্দারণির কিছুটা আগেই। জায়গাটার নাম দাদনপাত্রবাড়। যদিও এটাকেই লোকে মন্দারমণি বলে।

আমরা উঠলাম পান্থ তীর্থতে। এখানকার হোটেলগুলোর একটা দরজা রাস্তার দিকে। একটা সমুদ্রের দিকে। যাওয়ার আগেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই বৃষ্টিতে সমুদ্রে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। আপন মনে ভিজব। ভিজতে না চাইলেও পরোয়া নেই। হোটেলেই ছাউনি আছে। সুন্দর সমুদ্রের ধারে বসে বৃষ্টি দেখে যাও।

মন্দারমণি গেলেও হোটেলের রেস্টুরেন্টে খুব একটা খাওয়া হয় না। এ ব্যাপারে অমিয়দার ঝুপড়ি হোটেলের বিকল্প নেই। হোটেলের মাচায় উঠে বসে যাও। আপন মনে সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকো। জোয়ার এলে সেই মাচার তলা দিয়েই জল চলে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভয় লাগারই কথা। কিছুক্ষণ গেলেই ব্যাপারটা সয়ে যাবে।

রাতেও অমিয়দার হাতের লা জবাব চিকেন কষা। সঙ্গে গরম গরম ভাত। অনেকে সুরা নিয়েই সন্ধেটা কাটিয়ে দিল। আমরা আবার এসব থেকে একটু দূরেই থাকি। সাদা চোখে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখার আনন্দটাই আলাদা। যারা লাল চোখে সমুদ্র দেখল, তারা জানলই না কী হারাল।

দূরে অনেক বড় বড় হোটেল। বিলাসবহুল। হেলানো চেয়ারে আধশোয়া হলে অনেকে শখের সমুদ্র দেখে। হোটেলে চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল খায়। তারা যদি অমিয়দার হোটেল দেখত!‌ এভাবেই কখন যে রাত বারোটা বেজে গেল, বুঝতেই পারিনি। হোটেলের ভেতর বাঁশের মাচায় অনেকক্ষণ কেটে গেল। প্রসূন চমৎকার গান গায়। একের পর এক গেয়ে গেল। আমিও মাঝে মাঝে সঙ্গ দিলাম। অনেকদিন পর যেন মুক্ত আকাশে উড়তে পেলাম।

mandarmoni4

আরও এক দু দিন থাকতে পারলে মন্দ হত না। আমার দিক থেকে সমস্যা ছিল না। কিন্তু প্রসূনের ছুটি একদিনের তাই পরদিন সকালেই ফিরে আসতে হল। তবে তার আগে ভোরটা পুরোমাত্রায় উপভোগ করে নিলাম। আকাশ পরিষ্কার। অনেকটা হেঁটে এলাম। একটু একটু করে আলো ফুটতে দেখলাম। কতদিন পর এমন স্নিগ্ধ ভোর দেখলাম। লকডাউনে বৃষ্টিভেজা এই সমুদ্র সৈকত যেন অনেকটা অক্সিজেন দিয়ে গেল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.