শ্রীপর্ণা গাঙ্গুলি
নীতা বাঁচতে চেয়েছিল। সিনেমায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সে এখনও দিব্যি বেঁচে আছে। বেঁচে আছে সেই সংলাপটাও।
বাংলা ছবির সেরা সংলাপ কোনটা ? যদি এমন একটা সমীক্ষা করা হয়, একেবারে সামনের সারিতেই থাকবে, সুপ্রিয়া দেবীর সেই সংলাপটা- দাদা, আমি বাঁচতে চাই। আপাতভাবে খুবই সাধারণ একটা কথা। কিন্তু মনকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। প্রায় সত্তর বছর পরেও তাই সংলাপটা অমর হয়ে আছে।
সুপ্রিয়া দেবীর জীবনে সেরা ছবি কোনটি ? মহানায়কের সঙ্গে অনেক ছবি আছে। কিন্তু সুপ্রিয়া দেবী নিজেও এগিয়ে রাখেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’। সেরা চরিত্র? অবশ্যই নীতা। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা এক ছিন্নমূল পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াই। একটি মেয়ের কঠোর আত্মত্যাগের বিনিময়ে একটি সংসারকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।
অথচ, এই উপন্যাসটির নাম কিন্তু মেঘে ঢাকা তারা ছিল না। শক্তিপদ রাজগুরু ‘চেনা মুখ’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেটি পড়েই ভাল লেগে যায় ঋত্বিক ঘটকের। ঠিক করেন, এই কাহিনি নিয়েই ফিল্ম বানাবেন। নাম রাখলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’। কোনও সন্দেহ নেই, ঋত্বিকের যে ছবি সবথেকে আলোড়ন ফেলেছে, তা হল এই মেঘে ঢাকা তারা।
আউটডোর লোকেশানের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল মেঘালয়ের শিলঙকে। ঋত্বিকের ক্যামেরা যেন অন্য এক শিলংকে ধরতে চেয়েছে। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে নীতার সেই আর্তিটা- দাদা, আমি বাঁচতে চাই। যেমন চিত্রনাট্য, তেমন দৃশ্যকল্প। যেমন অভিনয়, তেমনি সঙ্গীত। সবাইকে দিয়ে সেরা কাজটা করিয়ে নিতে পেরেছিলেন ঋত্বিক।
প্রযোজক চেয়েছিলেন, গল্পটা যেন একটু বদলানো হয়। এই লড়াইয়ের পর নীতার যদি মৃত্যু হয়, তাহলে মেয়েরা লড়াই করার অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলবে। তাই নীতাকে বাঁচিয়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। লেখক শক্তিপদ রাজগুরু গল্পটা বদলে দিতে রাজিই ছিলেন। বিগড়ে বসলেন ঋত্বিক। তাঁর সাফ কথা, ‘সবকিছু মিলনান্ত হয় না।’ তিনি চেয়েছিলেন, নীতার মৃত্যুই অনিবার্য পরিণতি। সেই মৃত্যু মানুষের মনে ঝড় তুলেছিল। সিনেমায় নীতা মারা গেছে ঠিকই। কিন্তু সেই চরিত্রটা দিব্যি বেঁচে আছে। বেঁচে আছে সেই সংলাপটাও। শুধু বেঁচে নেই। সেই সংলাপটা সময়ের গণ্ডি টপকে অমরত্ব পেয়ে গেছে।