এই গরমে কামাখ্যায়, মন্দী কী?‌

গরমের ছুটিতে পাহাড় মন্দ কী?‌ আর তা যদি কামাখ্যা হয়, তাহলে তো বেড়ানো, তীর্থযাত্রা একসঙ্গে হয়ে গেল। কামাখ্যার অনেক অজানা ইতিহাসও এই ফাঁকে জেনে নেওয়া যাক। লিখেছেন বৈশালী গাঙ্গুলী।

গরমের ছুটি পড়ে ২১ মে ২০১৭। ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচী থেকে, কোথাও পাহাড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই দারুণ লাগছিল। মেয়ে, মা বেরিয়ে যাই আমার জন্মস্থান আসাম পাহাড়ে। তাই রাঁচী- কামাখ্যা এক্সপ্রেসে চেপে দেড় দিন, এক রাত্রির যাত্রা করে পৌঁছে যাই, কামরূপ কামাখ্যা স্টেশনে। যদিও আমি ছোটবেলা থেকে, মা কামাখ্যা মন্দিরের সিঁড়ি শুরুর অঞ্চল কামাখ্যা কলোনিতেই বড় হয়েছি। তবুও পাহাড় আমাকে সব সময় আকর্ষণ করে। কামাখ্যা স্টেশন পৌঁছে যাই ঠিক রাত এগারটায়। এখন গৌহাটিতেও ওলা, উবেরের খুব ধুম।

বাড়িতে এক রাত জিরিয়ে, পরের দিন সিঁড়ি ভেঙ্গে তৈরি হই, কামাখ্যা মায়ের দর্শনের ইচ্ছে নিয়ে। আধুনিক যুগ যে মায়ের মন্দিরের নীলাচল পাহাড়কে অনেক বদলে দিয়েছে। খুব বোঝা যাচ্ছিল। আগে যে সমস্ত জায়গায়, শাল, তাল, সেগুন, নারকেল গাছ আর বাঘ, বানর, সাপে ভর্তি ছিল। আজকাল দেখছি পাহাড়ের আনাচে, কানচে আর.সি.সি বিল্ডিং হয়ে গেছে। অনেকটা পর্যন্ত আসামের পুরাতত্ত্ব অফিসের অনুমতিতে সিঁড়িকে ভেঙ্গে, গৌহাটি মিউনিসিপ্যালিটি রাস্তা বানিয়েছে, গাড়ি ওঠানোর জন্য।

kamakshya2

সবার প্রথম আমি, আমার ভাই দর্শন করি, প্রথম মন্দির বাবা গণেশের। মন্দিরের ভেতরে পাথরে খোদাই করা গণেশ, লাল সিঁদুরে লালময়, আর পাথর ভক্তের ভক্তির দীপ, ধুনাতে কালো নরক হয়েছে। কিন্তু ওই একটা সোঁদা গন্ধে ছোট্টবেলা থেকেই ভক্তি আসে। তারপর শুরু হল আসল পাহাড় ভেঙ্গে ওঠা। যদিও আমি, বলি- পা ভেঙ্গে ওঠা। কিন্তু চারদিকের আকাশ ছোঁয়া গাছের মধ্যে হাঁটতে, আর সিঁড়িগুলির ইতিহাসের রোমহর্ষকতা চিন্তা করলে, বেশ মজাই লাগে। আর আজকাল তো ওই মোবাইল জিন্দাবাদ, ক্ষণে, ক্ষণে ছবি পাহাড়ের উপর থেকে দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের, বাক্সের মত ঘরের শোভা তোলা হচ্ছিল। মনে হল বাঁচা, ‘জয় মা কামাখ্যা আর মোবাইল ক্যামেরার সৃষ্টিকর্তা।’

তিনটি খাড়া চড়াইয়ের পর গিয়ে পৌঁছলাম মন্দিরের লাইনে। সেদিন ছিল অমাবস্যা আর ফল হরনী কালি পুজো। মহিষ, ছাগল, কবুতর বলি ঘরে লাইন দিয়েছে -“মা, মা,” চিৎকার দিয়ে, মানুষের পাপ নিজের রক্ত দিয়ে দেবে। মানুষের লাইনেও বহর, ধনী পাঁচ শত টাকা দিয়ে শীতাতপ খাঁচায় দুঘন্টা পরে দর্শন। সাধারণ হলে কাকভোর থেকে শেষ না হওয়া লাইনে দাঁড়িয়ে, অনিশ্চিত সময়ের পর দর্শন। আর সৈন্যবাহিনীর কার্ড থাকলে, সৈন্যদের জন্য মাথা পিছু দুটো। আর বৌ, বাচ্চার পাসে একটি টিকিটে তিন ঘন্টা দাঁড়িয়ে দর্শণ।

লাইনে ভাই যে শিলচরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তাঁকে মন্দিরের কাহিনী একবার নিজের মত করে বলি। নতুন প্রজন্মকে আমাদের জায়গার গৌরব নিয়ে বলা আমি কর্তব্য মনে করি। আষাঢ় মাস মানে বর্ষা । আর বর্ষণ হল সৃষ্টির প্রতীক । এই মাসেই কামাখ্যা মন্দিরে পালিত হয় সৃষ্টির আর এক প্রতীক । কারণ হিন্দু ধর্মে বলা হয়, বছরে এই একবারই তিনদিনের জন্য রজঃস্বলা হন দেবী কামাখ্যা । যিনি দেবী দুর্গার আর এক রূপ।
১০৮ টা সতীপীঠের অন্যতম এই তীর্থস্থানের উল্লেখ আছে সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণের লেখা এলাহাবাদ প্রশস্তিতে। এছাড়া হিন্দু পুরাণ তো রয়েছেই। যেখানে তাণ্ডবরত মহাদেবের কাঁধে আত্ম ঘাতী সতীর দেহ ৫১ টুকরোতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যায় সতীর দেহলতা। কিন্তু কোথায় পড়ে সতীর গর্ভ আর যোনি? জানা যায় না। অবশেষে কামদেব খুঁজতে শুরু করেন। ব্রহ্মার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে তাঁকে সেটা খুঁজে বের করতে হত। আজকের আসমে নীলাচল পাহাড়ের উপরে পাওয়া যায় সতীর গর্ভ ও যোনি। কামদেব খুঁজে পান বলে এই জায়গার নাম হয় ‘কামরূপ’ । এবং কামদেবের আরাধ্যা বলে দেবীকে বলা হয় ‘কামাখ্যা’। ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই মন্দিরকে নতুন করে বানান কুচবিহারের রাজা নরনারায়ণ । ১৬৬৫ তে। হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত জাগ্রত এই মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে পাথরের ভাস্কর্য। তাকেই দেবীর যোনি হিসেবে পুজো করা হয় । প্রাকৃতিক ঝর্ণা এই পাথরকে সবসময় ভিজিয়ে রাখে। সাথেসাথ লাইনের পাশেই মন্দিরের দেওয়ালে যৌনিমুদ্রায় মায়ের একটি ছবি তুলে আনতে বলি ভাইকে।

কামাখ্যা মন্দিরের সবথেকে বড় উৎসব হয় অম্বুবাচীতে। বলা হয়, আষাঢ় মাসে এই তিনদিন ঋতুমতী হন দেবী কামাখ্যা। বন্ধ রাখা হয় মন্দির। জনশ্রুতি, ওই তিনদিন লাল হয়ে যায় পাথরের ওই ভাস্কর্যও। বছরের ওই কটা দিন রং পাল্টায় কামাখ্যা মন্দির লাগোয়া ব্রহ্ম পুত্র নদও। হয়ে যায় লাল । কিন্তু এর পিছনে কোনও প্রাকৃতিক কারণ আছে কি? জানা যয়ানি। অনেকে বলেন, কামাখ্যা মন্দিরের পুরোহিতরাই নদের জলে প্রচুর সিঁদুর ঢেলে দেন। তাতেই লাল হয়ে যায় রং। কিন্তু সনাতন হিন্দুত্ববাদীরা মানতে চায় না সিঁদুর তত্ত্ব। তাদের কাছে সবই বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

kamakshya1

সময় এলো আমরা ওই “মা, মা” আর আত্মত্যাগের আর্তনাদ শুনে, ভক্তিমতী মেয়েদের জামা কাপড় লাইনের খাঁচা থেকেই দেখছিলাম। আর সবার প্রদীপ জ্বালিয়ে মন্দিরের বাইরে দর্শণের পরে বড়, বড় সিঁদুরের তিলক কেটে ঘুরে বেড়ানো দেখতে খারাপ লাগছিল না। ভিতরের গহ্বরের ঢোকার আগে, মহিষটি বলির পরে, নিজের মণ্ডর সাথে জিহ্বা বের করে পায়ের পাশে উৎসর্গ হয়েছে দেখলাম। প্রথম ছিল ওই দৃশ্য, সবাই নির্বিকার হয়ে ভক্তিতে ওতপ্রোত ছিল। আমি বেশিসময় ওই দৃশ্য না দেখতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে দিলাম। নিচে কোনও মন্ত্র নেই, জল স্পর্শ করে বেরিয়ে এলাম। পান্ডা (পুরোহিত) যোনি পাথরের জল বলে, দুটো প্লাস্টিক বেঁধে দিল, আর দুই শত টাকা চাইল। দিলাম, শুনেছি মন্দিরে বেশি দরদাম করতে নেই। শেষে ছবি তুলে এলাম একটু নিচে দোকানে চা, সিঙাড়া খেয়ে, বাড়িতে পৌঁছলাম, পায়ে হেঁটে ওই পিচ্ছিল পাথরের পথে।

ভাই একটা দারুণ কথা রাস্তায় বলে- ” কামাখ্যা মন্দির আমাদের জন্য গতানুগতিক একটি মন্দিরে যাওয়া, তাই আমরা বেশি ভাবি না। তাই হত, অনেক জিনিসকে মেনে নিয়ে প্রশ্ন করি না। সত্যি, মিথ্যা বিচার করি না।” আমাদের সামনে একজন পান্ডা একটি ছাগলের বাচ্চা, যাকে বলি না দিয়ে ছেড়ে দাওয়া হয়েছিল, সেটাকে টেনে, হেঁচড়ে নামাচ্ছিল। ওটা বেশ আমাদের আগেই নেমে গেল, বোঝা গেল দুপুরের খাওয়ার সময় হয়েছে। তাই ওর খিদে না পেলেও, পুরোহিত (পান্ডার) খিদে তো পেয়েছেই। মায়ের কৃপাতে কেউ ভক্ত, কেউ দিচ্ছে রক্ত, কেউ অভুক্ত, কেউ কামাচ্ছে টাকা লক্ষ। মেয়ের জন্য ইংরেজির বই নিয়ে এলাম। চেষ্টা করছি, স্বপ্ন দেখছি- “পরিবর্তন আসবে”!
“জয় মা কামাখ্যা।” একটি পাহাড়ের যাত্রা শেষ করে বলি- মাকে, “আসছে বছর যেন আবার আসি মা। ”

invitation

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.