হারিয়ে যাওয়া সেই মহালয়া

সেই রেডিওটা আজও আছে। ধুলো ঝেড়ে আর নামানো হয় না। আর ব্যাটারি ভরে প্রাণসঞ্চার করা হয় না। না বোঝা সেই মহালয়ার অনুভূতিটাও একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে। ফেলে আসা সেইসব শরৎ–‌শিউলি ভোরের নস্টালজিয়া। উঠে এল অন্তরা চৌধুরির লেখায়।

‘মহালয়া’ ব্যাপারটা ঠিক কী, ছোটবেলায় একেবারেই বুঝতাম না। শুধু এটুকু বুঝতাম মহালয়া এল মানেই পুজো চলে এল। একের পর এক শুধু দিনগোনা। এখন যেমন সারাবছর ধরেই কেনাকাটা চলে, তখন তো এমন ছিল না। নতুন জুতো জামা সব পুজোর সময়েই কেনা হত। অনলাইনে কোনওদিন কেনাকাটা হবে, তখন এসব সূদূরতম ভাবনাতেও ছিল না।
বাড়িতে মান্ধাতা আমলের একটা বিশাল রেডিও ছিল। সারাবছর অনাদরে, অবহেলায় পড়ে থাকত। কিন্তু পুজো এলেই তার কদর বেড়ে যেত। ধুলো–‌টুলো মুছে ব্যাটারি পাল্টানো হত। মাঝে মাঝে সেই রেডিও মহালয়ার আগে নার্সিংহোম থেকেও ঘুরে আসত, যাতে মহালয়াটা অন্তত ঠিকঠাক শোনা যায়। দু তিনদিন আগে থেকে তর্ক হত মহালয়াটা কবে! আজকের ভোরে না কালকের ভোরে। এই নিয়ে যত জল্পনা।

radio3
কেন জানি না, শরৎকাল এলেই ভোরবেলায় হাঁটতে যেতে খুব ইচ্ছে করত। পাড়ায় পাড়ায় প্যাণ্ডেলের প্রস্তুতি। আকাশে শরতের মেঘ, বাতাসে শিউলির গন্ধ। চারিদিকে বেশ একটা পুজো পুজো ভাব। ভোরের আলতো আলোয় আঁচল ভরে শিউলি ফুল কুড়োতাম। সেই গন্ধ যে কী ভাল লাগত!‌ মহালয়ার আগের দিন ভাবতাম, কাল ভোর চারটের মধ্যে উঠতে হবে। না উঠলে কী মহাভারত অসুদ্ধ হবে বুঝতাম না। কিন্তু সেদিন আর কিছুতেই ঘুম ভাঙতে চাইত না।
ওদিকে তখন ভোরবেলায় বাড়িতে হুলুস্থুলুস কাণ্ড। এমন চিৎকারে কার সাধ্য ঘুমোয়! যেন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। কারণ কী? কিছুতেই নাকি কলকাতা ক ধরছে না রেডিওতে। আমার তিয়াত্তর বছরের ঠাকুমা ভোর তিনটে থেকে জেগে গেছে। একবার বাবাই, একবার ফুলকাকা একবার ছোটকা রেডিওর নব ঘুরিয়েই চলেছে। ব্যাপারটা অনেকটা হরধনু ভঙ্গের মত। এক একবার একজন চেষ্টা করছে আর ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু কাউকেই বোঝাতে পারছি না যে এখনও ভোর চারটে বাজেনি।
অনেক কষ্টে অবশেষে ‘আজ আশ্বিনের শারদ প্রাতে’ দিয়ে মহালয়া শুরু হল। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র উদাত্ত কণ্ঠে পাঠ করে চলেছেন। গোটা ঘর বেশ গমগম করছে। ঠাকুমা শুনছে আর একবার করে প্রণাম করছে। কাকে করছে জানি না। মুখে বেশ ভক্তি ভক্তি একটা ভাব। সবাই একটা ঘরে চুপ করে বসে মহালয়া শুনছে। আমিও শুনছি। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে পার্থক্যটা হচ্ছে বাকিরা এমন ভাব করে আছে যেন কতই বুঝছে! এদিকে আমি কিন্তু কিছুই বুঝছি না। শুনতে ভাল লাগত তাই শুনতাম। কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, কে বাণীকুমার, এসব কিছুই চিনতাম না। তা সত্ত্বেও পরম নিষ্ঠা নিয়ে বসে থাকতাম। অপেক্ষা করতাম কখন সেই ‘জাগো তুমি জাগো’ গানটা হবে। ওই গানটাই ছিল সবচেয়ে পছন্দের তালিকায়। কিছু না বুঝলেও এটুকু অন্তত বুঝতাম যে ওই গানটা গেয়েই মা দুর্গার ঘুম ভাঙানো হয়। অন্যসময়টা মা দুর্গার ছুটি। দুর্গাঠাকুরের কী মজা! পড়াশোনা করতে হয় না। পরীক্ষা দিতে হয় না। সারাবছর ঘুম। শুধু একবার কষ্ট করে মহালয়া শুনে মর্ত্যে আসতে হয়।

mahalaya2
তবে শেষের দিকে আর ধৈর্য থাকত না। বাইরে তখন দুমদাম ফটকা ফাটছে। একঘণ্টা ছাড়া ছাড়া চা পর্ব চলছে। যেই না পাঁচটা বাজল অমনি আমি টিভির সামনে। অত ছোটবেলায় মহালয়া শোনার চেয়ে দেখতেই বেশি ভাল লাগত। মা দুর্গা ধিতাং ধিতাং করে নাচ করবে, আর মহিষাসুর কাকুকে ঘ্যাচাং ফু করে দেবে। প্রত্যেক বছর সেটা দেখার জন্যই টিভিতে মহালয়া দেখার এত উৎসাহ।
মহালয়া শেষ হওয়ার পর বড়জেঠু যেত নদীতে তর্পণ করতে। তর্পণের মানে তখন বুঝতাম না। যাকেই জিজ্ঞাসা করতাম মহালয়া মানে কী? সবাই নিজেদের মত করে ভারী ভারী উত্তর দিত। কেউ বলত আজ থেকে পিতৃপক্ষ শেষ, দেবীপক্ষের শুরু। কেউ বলত আজ থেকে দেবীর বোধন শুরু। ঠাকুমা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল। তর্পণ মানে পিতৃপুরুষকে জল দেওয়া। আমি অতশত না বুঝলেও এটুকু বুঝতাম, মহালয়া এল মানেই পুজো এসে গেল। চারিদিকে অফুরন্ত আনন্দ। পড়ার জন্য আর কেউ বকবে না। এই কদিন জমিয়ে শুকতারা পড়া যাবে। টিনটিন, হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট! অত ছোট বয়সেও বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হত না। কারণ প্রত্যেকটাতেই প্রচুর ছবি দেওয়া থাকত। আহা! ‘‌আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’‌। আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হওয়ার জন্য বাড়তি আনন্দ তো থাকতই। পুজো শেষে খাওয়া দাওয়া সেরে সোজা চিলেকোঠার ঘরে। সঙ্গে কোনওবার শুকতারা, কোনওবার আনন্দমেলা।
এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছি। মহালয়া শোনার সেই উত্তেজনাটা নেই। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র এখন মুঠোফোনে বন্দী। ইচ্ছে হলেই যখন খুশি ডাউনলোড করা যায়, শোনা যায়। তার জন্য অত কষ্ট করে ভোর চারটে থেকে ওঠার কোনও মানে হয়! আমাদের বাড়িতে সেই বহু স্মৃতি বিজড়িত রেডিওটা এখনও আছে। অনাদরে অবহেলায় বাড়ির এককোণে পড়ে আছে। আগে তবু একটা দিন ধুলো ঝেড়ে নামানো হত, ব্যাটারি ভরে প্রাণসঞ্চার করা হত। এখন আর তাও হয় না। এই পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দিন গুনছে। আজ ঠাকুমা নেই, ফুলকাকা নেই। আর যারা আছে তাদের কাছেও মহালয়া আজ আর কোনও বাড়তি গুরুত্ব পায় না। মহালয়া সুলভ মূল্যে এত অতিরিক্তরকম পাওয়া যায় বলেই হয়তো সেই পাওয়ার আনন্দটা হারিয়ে গেছে।
এখন মহালয়াও আছে। শরৎশিউলি ভোরও আছে। নেই শুধু সেই ছেলেবেলা।

 

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.