রাহুল চক্রবর্তী
দেশের হাল-হকিকত দিব্য। একদিকে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাত’ প্রায় এল বলে। পশ্চিমবঙ্গ এবং আর যেখানে যেখানে বাঙালি জনগোষ্ঠী আছে, তাদের একটা বড় অংশের মনে ঢাকের বাদ্যি বাজতে শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে দেশের বাকি অংশ গণপতি পূজা, ওনাম পার করে দীপাবলীর জন্য মনে মনে তৈরি হতে শুরু করেছে। আর তো মোটে একটা মাস।
ক্রিকেটে ভারত প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করছে, ফিফা যুব বিশ্বকাপের থিম সং বেরিয়ে গেছে, অ্যামাজনে-ফ্লিপকার্টে সেল চলছে, ডোকলামে চীনকে দিব্যি ধোকলা খাইয়েছেন ভারতের গুজরাতি প্রধানমন্ত্রী। কিছু নিন্দুক বলছে বটে অর্থনীতির উন্নতির গতি শ্লথ থেকে শ্লথতর হচ্ছে, কিন্তু তাতে কবেই বা কার কি এসে গেছে। সৈন্যবাহিনী তো কত কষ্টই সহ্য করে; তাদের কথা ভেবে অর্থনীতির অধোগতিটাও না হয় মেনে নেবে। মোদ্দা কথা দেশ জুড়ে সুশাসনের সুপবন বইছে।
এমন অবস্থায়, দেশের উত্তর-পূর্ব কোণের একটা রাজ্যের কিছু লোক কী যেন বলছে। বেশ কয়েক দিন ধরেই। শুনবেন নাকি একটু কান পেতে? অসীম ব্যস্ততা, ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে নিত্য হাজিরা, অ্যামাজনের সেলের মাঝে ১০ টা মিনিট বের করা যায় কি?
আসাম বলে দেশের উত্তর-পূর্বে একটা রাজ্য আছে (কি জানি বাবা, অনেকে নাই জানতে পারে। বেশি কোনও সংবাদপত্রে তো দেখিনি এই নিয়ে নিয়মিত খবর..তাই)। সেখানকার কাছাড় এবং নগাঁও এলাকাতে রাজ্য সরকারের অধীনস্থ সংস্থা হিন্দুস্থান পেপার কর্পোরেশনের দুটি কাগজকল আছে। তো, তাতে কী! সে তো থাকতেই পারে, থাকা তো ভাল। নয় কি?
অবশ্যই, তবে ঘটনা হল কি বিগত ১০-১১ মাস ধরে ওই দুই সরকারি অফিসে বেতন বন্ধ। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন, বন্ধ। ১-২-৩ মাস না, ১১ মাস। রামরাজত্ব কিন্তু ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। যুগাবতার এসে গেছেন সিংহাসনে।
আচ্ছা, বেতন বন্ধ মানে কি জানেন? এর মানে বাচ্চাদের পড়াশুনা, খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ, ওষুধ, জীবনবীমা – সবেতে টান। ফ্লিপকার্টের সেল, কি দুর্গাপূজার ঢাকের বোল, কিংবা ভদ্রবাবুর মহালয়া – সবকিছু পানসে লাগা। চাইলেও কাছের মানুষকে কিছু না দিতে পারা। কোনও শ্রমিক আন্দোলন থেকে কিন্তু এসব হয়নি। কবে, কি থেকে শুরু হয়েছিল সে সেব গুগলবাবার থেকে আরাম করে জেনে নিতে পারবেন। আসল কথাটা হল, ১১ মাস ধরে ১৫০০ প্রত্যক্ষ কর্মীর বেতন বন্ধ। একবার শুধু ভাবুন তো যে পরের মাসে অ্যাকাউন্টে সময় মতন টাকাটা না ঢুকলে আপনার আমার কেমন মনে হবে? হঠাৎ করে সন্তানের মুখটা ভেসে উঠল কি? চাপ নেবেন না, আপনারটি আপাতত আরামেই আছে। পুজোতে নতুন জামাটা হবে ওর। ওই ১৫০০ জনের হবে না। সে না হয় একবার নাই হল, কিন্তু স্কুলের খরচা? দরকার পড়লে চিকিৎসা – কী হবে? ভাবতে কেমন লাগছে? ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দিলেন? তা দিন।
জানেন, সরকার বলেছে – হবে, সব ঠিক হবে। কবে হবে? প্রশ্নের উত্তরে হাতে থেকেছে পেন্সিল। একটা একটা করে মাস গেছে। আচ্ছা এভাবে কি চাইলেই সরকার পারে কয়েক হাজার মুখের ভাত অনিশ্চিত করে দিতে? পারা উচিত কি? কিন্তু সরকার পারছে। যখন সুপবন বয়, তখন সামান্য কটু গন্ধ কি আর নাকে আসে? তাছাড়া সর্বভারতীয় (এমনকি বাংলারও) সংবাদমাধ্যম তো নমো নমো করে (আক্ষরিক অর্থেই) একটু বুড়ি ছুঁইয়েই খালাস। আপনিই বা জানবেন কী করে! তাই না? এই তো জানলেন, এবারে কী করবেন? রাতের খাওয়া শেষ? কাল আপনাদের অফিস, ছেলে মেয়ের স্কুল? কেমন হত যদি একলহমায় সব মিথ্যা হয়ে যেত। এগারোটা মাস বড় কম সময় নয় তো। আরো কত মাস কেউ জানে না। হাল ছেড়ে দিয়ে কিছু ক্ষুধার্ত মুখ হয়ত রেললাইনে মাথা বা গলায় দড়ি দেবে। কিছু মানুষ হারিয়ে যাবে। এর দায় কে নেবে? কেউ না, মানুষ তো হারিয়ে যাওয়ার জন্যই জন্ম নেয়, তাই না?
আপনি আমি তো দিব্য আছি। ফোনের মডেল বদলাচ্ছি, পপকর্ণ খেতে খেতে রোম্যান্স দেখছি, বুলেট ট্রেন আর আগত সুসময়ের (আচ্ছা বাবা আচ্ছে দিনের) গাজরটাও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু রামরাজত্বের ঈশান কোণে মেঘ জমছে যে। ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ, সাঁই সাঁই শব্দ শোনা গেলে?
একজন যুগন্ধর বলে গেছিলেন – ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস কর। ভাবতে শুরু করুন। মেঘ কিন্তু এক জায়গাতে থেমে থাকে না।