বিমল গুরুং বলছি

(‌পাহাড়ের গোপন ডেরা থেকে হুঙ্কার ছেড়েই চলেছেন বিমল গুরুং। ধরা যাক, তিনি বিনয় তামাংকে বার্তা দিতে চান। চিঠি লিখতে চান। কী লিখতেন সেই চিঠিতে। উঠে এল বেঙ্গল টাইমসে। বিমলের বয়ানে সেই চিঠিই লিখলেন স্বরূপ গোস্বামী।।)‌

বিনয়ভাই,
হ্যাঁ, এখনও তোমাকে ভাই বলেই ডাকছি। মাঝে মাঝেই আমি ভিডিও বার্তা ছাড়ছি। হুঙ্কার দিচ্ছি। এটা ভিডিও বার্তাও নয়। হুঙ্কারও নয়। ছোট ভাইয়ের প্রতি বড় দাদার পরামর্শ।
ইতিহাসের কী নির্মম পরিণতি। মাস তিনেক আগেও আমি পাহাড়ে রাজার মতো ঘুরে বেড়াতাম। আজ পুলিশ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমে গিয়েও নিস্তার নেই। সেখানেও ধাওয়া করছে বাংলার পুলিশ। নানা দিক থেকে চাপ বাড়াচ্ছে। লুক আউট নোটিশ জারি করেছে। কী জানি, এবার হয়ত দেশের বাইরেই পালাতে হবে।

binay tamang
আমার এই অবস্থা দেখে তোমার নিশ্চয় খুব আনন্দ হচ্ছে। ভাবছ, এবার পাহাড়ের রাশ থাকবে তোমার হাতে। তোমার কথাতেই পাহাড় উঠবে–‌বসবে। এই ধারনা এখনই মন থেকে মুছে ফেলো বন্ধু। তুমি জেনে রেখো, তুমি কেউ নও। তুমি হাতের পুতুল মাত্র। তোমাকে ততদিনি গুরুত্ব দেওয়া হবে, যতদিন তোমাকে দরকার। তারপর তোমাকেও এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে লুকিয়ে বেড়াতে হবে। কী জানি, তার থেকেও হয়ত ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে। জঙ্গলমহলে কার যেন হয়েছিল!‌
সময় থেমে থাকে না। রাজ্যপাটও বদলায়। একদিন সুবাস ঘিসিংয়ের কথায় চলত পাহাড়। বছর দশেক আগে, আমার রাজত্ব শুরু। সরাসরি বিদ্রোহ করেছিলাম। জানতাম, ঘিসিং সাহেব পাহাড়ে থাকলে ঠিক একসময় ঘুরে দাঁড়াবে। তাই ঘিসিং সাহেবকে পাহাড়ছাড়া করেছিলাম। খুব যে আনন্দ পেয়েছিলাম, তা নয়। কিন্তু নিজের সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখতেই এমনটা করতে হয়েছিল।
তুমি ভাবছো, আমার জায়গাটা তুমি দখল করেছো। তোমাকে সেটাই বোঝানো হচ্ছে। রাজ্য বলছে, আমরা তোমার সঙ্গে আছি। তুমি মোর্চায় ভাঙন ধরাও। তুমি পুলিসের ঘেরাটোপে এক–‌দুটো মিটিং করে ভেবে নিলে, পাহাড়ের মানুষ তোমার সঙ্গেই আছে। ভেবে নিলে, তুমি হয়ত শাহেনশা হয়েই গেলে। বাংলার কাগজগুলো দিদিমণির ভয়েই অস্থির। তাঁবেদারির কম্পিটিশন চলছে। দিদিমণি রেগে যায়, এমন কোনও কথাই তারা লিখবে না। লিখে চলেছে, তুমিই নাকি পাহাড়ের নতুন নেতা। কারণ, দিদিমণি এমনটাই চায়। এরা সত্যিই অসহায় নাকি নির্বোধ, কে জানে!‌

হ্যাঁ, আমি এখন লুকিয়ে বেড়াচ্ছি, এটা ঘটনা। কিন্তু জেনে রেখো, পাহাড়ের ওপর, মোর্চার ওপর তোমার থেকে আমার প্রভাব এখনও অনেক বেশি। সবাই যে আমাকে খুব মন থেকে ভক্তি করে, এমন নয়। অনেকে ভয়েই ভক্তি করে। কিন্তু তারা যে তোমার দলে নাম লেখাবে, এমনটা ভেবে নিও না। তোমার মতো লেখাপড়া আমার ছিল না। তবে সাহস ছিল। মনের জোর ছিল। ঘিসিংকে নিজের জোরেই পাহাড়ছাড়া করেছিলাম। তোমার মতো রাজ্য সরকারের পুতুল হয়ে যাইনি। আমার পেছনে পুলিশও ছিল না, শাসক দলও ছিল না। বরং তারা ঘিসিংকেই বহাল রাখতে চেয়েছিল। আমি যা করেছি, নিজের জোরেই করেছি। কিন্তু তুমি একদিন হুঙ্কার ছাড়লে, পরের দিন নিজেই গৃহবন্দী হয়ে গেলে। বাইরে পুলিশে ছয়লাপ। তারা সবাই তোমাকে পাহারা দিচ্ছে। সব সময় আমার ভূত দেখছো। আমি নাকি তোমাকে খুন করতে পারি।
না বন্ধু, আমি মোটেই এমনটা করব না। আমি জানি, একদিন তোমার ভুল ঠিক ভাঙবে। তোমার থেকেও শিক্ষিত লোক ছিল হরকা বাহাদুর ছেত্রি। রাজ্য সরকার তাকে তোল্লাই দিতে শুরু করল। মোর্চা ভাঙার কাজে তাকে ব্যবহার করল। সে নিজেও ভাবল বোধ হয় বিরাট হনু হয়ে গেছে। দিদিমণির গ্যাস খেয়ে সেও বিদ্রোহে নেমে পড়ল। ফল কী হল?‌ বিধানসভায় গো হারান হারতে হল। এমনকী পুরসভা ভোটেও হালে পানি পেল না।

gurung
এত সহজ নয় বন্ধু। গ্যাস খাওয়ার পরিণতি কী হতে পারে, হরকা বাহাদুর বুঝিছিল। তুমি কি তার থেকেও বাহাদুর?‌ তুমি কিনা বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে পাঙ্গা নেবে?‌ তুমি বললে, আমার দুর্নীতি ফাঁস করবে। যত খুশি ফাঁস করো। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি দারুণ সৎ, একথা আমি নিজেই বিশ্বাস করি না, লোকে কেন করবে?‌ আমি দারুণ ভদ্রলোক?‌ আমার অতিবড় ভক্তও বলবে না। আমি মস্তানি করি, তোলাবাজি করি, এ আর নতুন কথা কী?‌ বিদেশে আমার সম্পত্তি আছে, এটাও সবাই জানে। আমি কেমন, সেটা সবাই জানে। জানার পরেও তারা আমাকেই নেতা বলে মেনে নিয়েছে। তুমি নতুন কী আর ফাঁস করবে?‌

আমি নাকি দেশদ্রোহী। আরে বাবা, আমি তো শুধু একটা আলাদা রাজ্য চেয়েছি। সেই দাবিতে আন্দোলন করেছি। সেই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকেনি। বছর দুই আগেই তেলেঙ্গানা আলাদা রাজ্য হল। তারা কি খুব শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছিল?‌ সেখানে বাস পোড়েনি?‌ গাড়িতে আগুন লাগানো হয়নি?‌ তারপরেও তাদের রাজ্য দেওয়া হল। আমাদের দাবি তো অনেক পুরনো। বারবার শান্তিপূর্ণভাবেই দরবার করেছি, দাবি জানিয়েছি, কোনও লাভ হয়নি। দিল্লিও বারবার লাড্ডু খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। সব ব্যাটাকেই চেনা হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়েই চরম আন্দোলনে নেমেছিলাম। আন্দোলন যখন চরমে পৌঁছচ্ছে, সেইসময় তুমি বেইমানি করলে!‌ যা যা শেখানো হচ্ছে, তুমি তাই তাই বলছো। এমন জো হুজুর করা তোতাপাখি কখনও নেতা হতে পারে?‌
নেতা হওয়া এত সহজ নয়, বন্ধু। আমি মূর্খ, তবু আমি শাসকের বিরুদ্ধে লড়ার হিম্মৎ দেখিয়েছি। আর তুমি শিক্ষিত হয়েও কিনা অন্যের শেখানো বুলি আওড়াচ্ছো। আমি যতই পালিয়ে বেড়াই, আমিই পাহাড়ের নেতা। তোমাকে পুলিশ নিয়েই ঘুরতে হবে। কী জানি, পুলিশের মধ্যেও হয়ত আমার ভূত দেখবে। অনেকেই মোর্চা ছেড়ে গেছে, আবার ফিরে এসেছে। একদিন তোমাকেও ওরা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। সেদিন তুমিও ফিরে আসবে। সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।

ইতি
বিমল দাজু

(‌না, এমন কোনও বার্তা বিমল গুরুং বেঙ্গল টাইমসের দপ্তরে পাঠাননি। এটা নিছকই কাল্পনিক একটি লেখা। কী জানি, মনে মনে গুরুংবাবু হয়ত এমনটাই ভাবছেন। গুছিয়ে লিখতে পারলে, এমন চিঠি হয়ত লিখেও ফেলতেন।)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.