যেখানেই তারুণ্য, সেখানেই সাফল্য, এই সহজ সত্যিটা বুঝলেন?

স্বরূপ গোস্বামী
যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হল। সহজ কাজকে কঠিনভাবে ব্যাখ্যা করার সেই পুরানো রোগটা অনেকে ভুলতে পারলেন না। তাই দুদিনের রাজ্য কমিটির আলোচনায় জোট ঠিক না ভুল, তা নিয়েই তর্কের তুফান উঠল। পরাজয়ের আসল দিকগুলো আলোচনার বাইরেই থেকে গেল।

যাঁরা জোট বিরোধী, তাঁদের কথা শুনলে মনে হবে, একা লড়লেই সিপিএম বোধ হয় ক্ষমতায় চলে আসত। গ্রামের মানুষ যেন সিপিএম-কে ভোট দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েইছিল, শুধু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হল বলেই শেষমুহূর্তে মত বদল করে তৃণমূলকে দিয়ে দিল।

বামেদের যে এমন অবস্থা হবে, কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন ? এমনকি এই ভরাডুবির পর যাঁরা নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলছেন, তাঁরাও কি এমন আশঙ্কা করেছিলেন ? জোট ক্ষমতায় আসতে পারে, ক্ষমতায় না এলেও নিদেনপক্ষে একশো দশ থেকে কুড়ি আসন আসতে পারে, এমনটা কি তাঁরাও মনে করতেন না ? ১৯ মে-র আগে পর্যন্ত তৃণমূলিরাও খুব বেশি নিশ্চিন্তে ছিলেন না। তাঁরাও মনে করছিলেন, সরকার পড়ে যেতে পারে। এই যে পাল্টা পরিবর্তনের হাওয়াটা উঠেছিল, সেটা জোটের জন্যই সম্ভব হয়েছিল।

madhuja sen roy
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যাঁরা বেশি তত্ত্ব আওড়ান, তাঁরা মানুষ থেকে তত বেশি বিচ্ছিন্ন। মানুষের আশা-আকাঙ্খা, চাহিদার কথা তাঁরা বুঝতেও পারেন না। একটা ফেসবুক পোস্ট দিলেন, সমমনস্ক কিছু লোক ‘লাইক’ মেরে দিল। ব্যাস, এতেই এঁরা ভেবে নিচ্ছেন মানুষ বোধ হয় সঙ্গে আছে। যদি সময় থাকে, একদিন ‘লাইক’ দেওয়া নামগুলো দেখুন। দেখবেন ঘুরে ফিরে ওই একই নাম। নতুন নাম তেমন নেই।

থাক সেসব কথা। ভেবেছিলাম অন্য একটা দিক নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু সেই আলোচনা কেউ করেছেন বলে অন্তত কাগজে দেখিনি। আপনারা একটা বিষয় কি লক্ষ্য করেছেন? যেখানে যেখানে তরুণদের প্রার্থী করেছেন, সেখানে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও সাফল্য এসেছে। হয়ত জয় আসেনি। কিন্তু দারুণ লড়াই ছুঁড়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কলকাতার লাগোয়া তিনটি কেন্দ্রের উদাহরণ দেওয়া যাক। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এবার প্রার্থী কে ছিলেন ? তরুণ মুখ কৌস্তভ চট্টোপাধ্যায়। হেরেছেন, কিন্তু কী দারুণ লড়াইটাই না করেছেন। পার্থ চ্যাটার্জির মতো হেভিওয়েট মন্ত্রী জিতেছেন মাত্র ৬ হাজার ভোটে। এটা সাফল্য নয়?

টালিগঞ্জে অরূপ বিশ্বাসেরও একই অবস্থা। এমন করিতকর্মা এক মন্ত্রী কিনা জিতলেন মাত্র আট হাজার ভোটে! বিপক্ষে কে ছিলেন ? একাবারে নতুন মুখ মধুজা সেনরায়। এমন নয় যে মধুজার সেখানে বাড়ি। মধুজার ঝাড়গ্রামের বাড়ি নিয়ে অনেক কটাক্ষ করেছিলেন অরূপ। কিন্তু ঝাড়গ্রামের সেই মেয়েটাই কিনা রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, মধুজার পরিবর্তে বয়স্ক কোনও প্রার্থীকে দাঁড় করালে তিনি হয়ত পঁচিশ বা তিরিশ হাজার ভোটে হারতেন।
shatarup ghosh3

এবার আসুন কসবা কেন্দ্রে। জাভেদ খান জিতেছেন, এটা ঘটনা। কিন্তু শতরূপের লড়াইকে কুর্নিশ করবেন না ? মনে রাখবেন, চারটে ওয়ার্ডে শতরূপ এগিয়ে। বেশিরভাগ বুথে এই তরুণ ছাত্রনেতা এগিয়ে। জাভেদ খান এগিয়ে গেলেন শুধু বিশেষ একটি অঞ্চলে। সেই এলাকায় অধিকাংশ বুথে অস্বাভাবিক ফল। এখানেও আমার ধারণা, শতরূপের পরিবর্তে বয়স্ক কোনও প্রার্থী করা হলে তিনি অধিকাংশ ওয়ার্ডেই পিছিয়ে থাকতেন। এবং অনেক বড় ব্যবধানে হারতেন।

এই কেন্দ্রগুলো অনেকে জানেন। তাই এইসব উদাহরণ আগে তুলে ধরলাম। আরও অনেক কেন্দ্র আছে, যা তুলে ধরলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। বলুন তো এবার বামেদের মধ্যে সব থেকে বেশি ভোটে কে জিতেছেন ? চাকুলিয়া কেন্দ্র থেকে আলি ইমরান (ভিক্টর)। তরুণ ও লড়াকু এই বিধায়ককে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী হুমকি দিয়েছিলেন, ‘তোমাকে দেখে নেব, তোমার কেন্দ্রে কী করে তুমি আবার জিতে আসো, দেখব।’ তরুণ সেই বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীকেই পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বসলেন, ‘আপনার সাহস থাকলে ভবানীপুর ছেড়ে চাকুলিয়ায় আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ান।’ হ্যাঁ, এই চ্যালেঞ্জটা ভিক্টর ছুঁড়তে পেরেছিলেন। সেই বুকের পাটা তাঁর ছিল, আছে। তাই এই চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মাঝেও তাঁর মার্জিন বেড়ে ২৭ হাজার হয়েছে। গভীরভাবে বিশ্বাস করি, তাঁর জায়গায় ফরওয়ার্ড ব্লক যদি অন্য কোনও তাত্ত্বিক নেতাকে প্রার্থী করত, ওই মার্জিন তো দূরের কথা, আসনটা হারাতে হত। কই, আপনাদের সভায় ভিক্টরের নাম বা তাঁর সাফল্যের কথা তো উঠে এল না। দু বছর আগের লোকসভা নির্বাচনের কথায় আসুন। রায়গঞ্জ লোকসভার পাঁচটি বিধানসভা মিলিয়ে মহম্মদ সেলিম ২৩ হাজার ভোটে পিছিয়ে। চাকুলিয়া আর করণদিঘি, যে দুই ব্লকে সিপিএমের তেমন সাংগঠনিক শক্তি নেই, সেই দুই কেন্দ্রের লিড ২৫ হাজার। তাই সেলিম দেড় হাজার ভোটে জিতেছিলেন। এই ২৫ হাজার লিডের নেপথ্যে যদি সবথেকে বেশি কারও কৃতিত্ব থাকে, তবে তা ভিক্টরের। এই তথ্যটা কজন জানেন ?

victor2

এই কঠিন সময়ে, শুভেন্দু অধিকারির জেলা থেকে একজন তরুণ বিধায়ক জিতে এসেছেন। তাঁর নাম ইব্রাহিম আলি। বয়স তিরিশের নিচে। কজন জানেন ?
সহজ কথা, যেখানে নতুন মুখ তুলে আনার ঝুঁকি নেওয়া গেছে, সেখানে সাফল্য এসেছে। হ্যাঁ, সেখানে তেমন সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও সাফল্য এসেছে। মানুষ কিছুটা হলেও ভরসা রেখেছেন। যেমন কোচবিহারের একটি কেন্দ্রের কথা জানি। স্বয়ং অশোক ঘোষ এক তরুণ ছাত্রনেতাকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। প্রায় চূড়ান্তই ছিল। কিন্তু শেষমুহূর্তে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির সেই লড়াকু ও তরুণ মুখের বদলে প্রার্থী করা হল এক পেটোয়া ঠিকাদারকে। ফল যা হওয়ার, তাই হল। কারা কোন স্বার্থে সেই পেটোয়া ঠিকাদারকে প্রার্থী করলেন, তার তদন্ত কি কোনওদিন হবে ? কারণ, যাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা হাওয়া ঘুরিয়ে দিতে অন্যসব তত্ত্ব আওড়াবেন। এক্ষেত্রেও গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ওই তরুণ ছাত্রনেতাকে প্রার্থী করলে ওই কেন্দ্রেও জয় আসত। নিদেনপক্ষে দুরন্ত লড়াইটা হত।
এমন অনেক উদাহরণ তুলে ধরা যায়। কিন্তু ঠান্ডা ঘরে বসে এসব নিয়ে ভাবতে তাঁদের বয়েই গেছে। এরপরেও যদি দেওয়ালের লিখন পড়তে না পারেন, তাহলে নিরক্ষর ছাড়া আর কী বলা যায় ? এরপরেও যদি সময়ের দাবি শুনতে না পান, তাহলে বধির ছাড়া কী বলা যায়?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.