স্বরূপ গোস্বামী
খবরটা পড়েই মন খারাপ হয়ে গেল। অমল দত্ত বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না ? কাউকে চিনতে পারছেন না ?
বয়স হলে শরীরে নানা রোগ ব্যধী আসে। এটা স্বাভাবিক নিয়ম। তবু মন ঠিক মানতে চায় না। বিশেষ করে লোকটির নাম যদি অমল দত্ত হয়।
বছর খানেক আগের কথা, অমল দত্ত গিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে। একজন জানতে চাইলেন, কেমন আছেন ? সৌজন্যের হাসি নয়, বরং বেশ রেগেই গেলেন প্রবীণ কোচ, ‘কেন এসব কথা জিজ্ঞেস করেন ? আমার সুগার নেই, প্রেসার নেই, কোলেস্টেরল নেই, অন্য কোনও রোগ নেই। আপনি পরীক্ষা করান। দেখবেন, এগুলোর অনেককিছুই হয়ত আপনার শরীরে আছে।’ এরকমই ঠোঁটকাটা ছিলেন। নিজের শরীর নিয়ে এরকম একটা অহঙ্কারও ছিল।
সারাজীবনে মদ ছুঁয়েও দেখেননি। সিগারেট খাননি। তেলমশলা থেকেও অনেক দূরে দূরেই থাকতেন। আশি বছর বয়সেও দেখেছি, টানা চার পাঁচ ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে কোচিং করিয়ে যাচ্ছেন। ফুটবলাররা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন, নিষ্কৃতি চাইছেন, কিন্তু তিনি ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।
এই পোড়া দেশে ফুটবল নিবেদিত প্রাণ বলতে যদি কাউকে বোঝাতে হয়, তিনি অবশ্যই অমল দত্ত। দেশের হয়ে খেললেও আহামরি খেলোয়াড় ছিলেন না। দেশের প্রথম একশো জন খেলোয়াড়ের তালিকায় কখনই তাঁকে রাখা যাবে না। কোচ হিসেবেও যদি সাফল্যের কথা ধরেন, তাহলে কিছুটা পিছিয়েই রাখতে হবে। অন্তত ট্রফি জেতার নিরিখে অন্যদের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। তবু কোচ অমল দত্তকে একটা বাড়তি শ্রদ্ধার আসন দিতেই হবে। বিশেষ করে ছোট দল নিয়ে তাঁর সাফল্য সবসময়ই ঈর্ষণীয়। আন্তর্জাতিক ফুটবলকে একরকম গুলেই খেয়েছিলেন। চার বছর ধরে একটু একটু করে টাকা-পয়সা জমিয়ে বিশ্বকাপের সময় ঠিক পাড়ি দেবেন দূর দেশে। বলতেন, আমার এই একটাই নেশা। মদ-গাঁজা খাওয়ার থেকে এই নেশা অনেক ভাল।
তখন পাঁচের দশক। হাতে টাকাকড়ি নেই বললেই চলে। তবু ঠিক করলেন কোচিং ডিগ্রি আনতে বিলেত যাবেন। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। চিড়ে মুড়ি বেঁধে সাগরপাড়ে পাড়ি দিলেন অক্ষয় বড়ালের নাতি। ফিরে এসে কোথায় কোচিং করেননি ? কখনও ছুটে গেছেন গোয়ায় চার্চিলের দায়িত্ব নিয়ে। কখনও মাসের পর মাস উঁটের মাংস খেয়ে পড়ে থেকেছেন ওড়িশার পান্ডববর্জিত এলাকায়। বড় দলের দায়িত্ব নিয়েছেন, ছেড়েওছেন নিজের খামখেয়ালিপনায়। তাঁর আসল কৃতিত্ব বোধ হয় ছোট দলেই। আটের দশকে মহমেডান শেষবার লিগ জিতেছিল তাঁর কোচিংয়েই। মোহনবাগানেও যখনই অবনমনের আশঙ্কা জোরদার হয়েছে, ডাক পড়েছে বাগুইআটির এই প্রবীণের।
স্বীকৃতি! যা জোটার কথা, তার কিছুই পাননি। কখনও আই এফ এ, কখনও ফেডারেশন, কখনও সরকার- তাঁর নিশানা থেকে কেউই বাদ পড়েননি। অমল দত্ত মানেই ঠোঁটকাটা, বিতর্কিত কথার ফুলঝুরি। অমল দত্ত মানেই অনিবার্য শিরোনাম। সব যে খুব সচেতনভাবে বলতেন, এমন নয়। অনেকটাই অভ্যেসবশত। ডিপ্লোমেসির ধার ধারতেন না। কে কী ভাবল, তা তাঁর ভাবতে বয়েই গেল। যা মুখে আসত, তাই বলে ফেলতেন। বিরক্তি এলে, তা চেপে রাখা তাঁর অভিধানে কখনই ছিল না।
তখন তিনি মোহনবাগানের কোচ। ইস্টবেঙ্গলে জাকুজি বসছে, নানা আধুনিক সরঞ্জাম আসছে। তিনি বলে বসলেন, ‘টাকা থাকলে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হয়, বেড়ালের মাসির বিয়ে হয়।’ নিজের ক্লাবকেও ছাড়লেন না। ঠিক তার কয়েক মাস পর। বলে বসলেন, ‘আমার ক্লাবের কর্তারা সব ম্যাদামারা। এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ এমন বললে চাকরি থাকে! তাই বারবার চাকরি গেছে। তিনি থেকে গেছেন নিজের মতোই।
বাংলায় সেরা লড়াই বলতে ঠিক কী কী বোঝায় ? কেউ বলবেন, সিপিএম-তৃণমূল। কেউ বলবেন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। এগুলো না হয় প্রাতিষ্ঠানিক লড়াই। আর ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির লড়াই ? মমতা-বুদ্ধ বা উত্তম-সৌমিত্র, এই জাতীয় উপমা কেউ কেউ টেনে আনতে পারেন। কিন্তু পিকে-অমল বাগযুদ্ধের কাছে যেন সবার জামানত বাজেয়াপ্ত। প্রায় চার দশক ধরে বাঙালি এই বাগযুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে। পিকে বলেছেন রেখে ঢেকে, কিছুটা ইঙ্গিতে। কিন্তু অমল দত্ত অনেকটা খোলামেলা, কোনও রাখঢাক বা ইঙ্গিতের ব্যাপার নেই।
দুজনকেই বারবার জিজ্ঞেস করেছি, আপনাদের এই ঝগড়া ঠিক কী নিয়ে ? পিকে একেক সময় একেকরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার অনেকটাই ডিপ্লোমেসিতে মোড়া। অমল কখনও বলেছেন, ‘ওর সঙ্গে কেন ঝগড়া করতে যাব ? ওর কী যোগ্যতা ? ও গায়ে গা পেড়ে ঝগড়া করে হেডলাইন হতে চায়। আর আমি ওর মতো আদিখ্যেতা করতে পারি না।’ আবার কখনও মুচকি হেসেছেন। কখনও হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে মাঝরাস্তায় নামিয়েও দিয়েছেন।
একটা সময় বেশ নিয়মিতই গিয়েছি তাঁর বাগুইআটির বাড়িতে। কখনও পরম স্নেহে খাইয়ে ছেড়েছেন, ডেকে গাড়িতে তুলে নিয়েছেন। আবার কখনও সেই গাড়ি থেকে নামিয়েও দিয়েছেন, মুখের উপর দরজা বন্ধও করে দিয়েছেন। কখনও ফোন ধরে বলেছেন, অমল দত্ত বাড়িতে নেই। পরিষ্কার তাঁর গলা, অথচ বলছেন নেই ? হয়ত বলে ফেললাম, আপনার গলাটা আমি চিনি। তখন বলে ফেললেন, ‘আমি নিজে বলছি, আমি নেই, তাও বিশ্বাস হচ্ছে না ?’ নানা সময় নানা খাতে বয়েছে সেই সম্পর্ক। তাঁর চরম তাচ্ছিল্যেও কখনও রাগ বা অভিমান হয়নি। কারণ, মানুষটাই ওইরকম। একটু ভাল মুডে থাকলেই শুনিয়ে গেছেন ফেলে আসা দিনের কথা। কীভাবে বায়োস্কোপ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন, লাহা বাড়ির উঠোনে ক্যাম্প খাট পেতে কীভাবে রাত কাটাতেন, ম্যাচরিপোর্ট করতেন। চিড়ে মুড়ি নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ থেকে ওড়িশার সেই উটের মাংস। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত-বিতর্কের কথাও উঠে আসত। তখন বিতর্কিত নয়, বরং ফুটবল-দার্শনিকই মনে হত। মনে হত, মানুষটাকে কেউ ঠিকঠাক বুঝল না। হয়ত দু-একবার কথাপ্রসঙ্গে তাঁকে বলেও ফেলেছি। নিউটাউনের পাশ দিয়ে হু হু করে ছুটছে গাড়ি। বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘কাউকেই কেউ বোঝে না। বিধান রায়কে কজন বুঝেছে ? বিদ্যাসাগর বলতেন, যেদিন আরেকটা বিদ্যাসাগর আসবে, সেদিন সে হয়ত বুঝতে পারবে, আমি কী করতে চেয়েছিলাম। আমার ক্ষেত্রেও তাই। কী করেছি, আমি নিজেই মনে রাখতে পারি না। যেদিন আরেকটা আমার মতো পাগল লোক আসবে, সে হয়ত আমার পাগলামি বুঝতে পারবে।’
এ দেশে আর কোনও অমল দত্ত কোনওদিন আসবে না। তাই তাঁর মূল্যায়ণ হবে, এমন সম্ভাবনাও নেই। সবজান্তা গুগল বা উইকিপিডিয়ায় তাঁর উপস্থিতি নামমাত্র। কে যেন বলেছিল, বাঙালি শুধু ডাউনলোড করতে শিখেছে, আপলোড করতে শেখেনি। তাই অমল দত্তর লড়াই, তাঁর ফুটবল-সাধনা রূপকথার মতো হলেও তা আড়ালেই থেকে যাবে। সোশাল সাইটে মাতোয়ারা নতুন প্রজন্মের সেসব বুঝতে বা জানতে বয়েই গেছে।
তাঁকে নিয়ে কোনও বায়োপিক হতে পারে না ? এমন বর্ণময় জীবন আড়াই ঘণ্টার চিত্রনাট্যে কে ধরে রাখবেন ? রবিবার পেলাম শ্রদ্ধেয় অশোক দাশগুপ্তর সেই মর্মস্পর্শী লেখা। জানতাম, পরের দিনই ছুটে যাবেন ক্রীড়ামন্ত্রী। ঠিক তাই হল। গেলেন দু-একজন প্রাক্তন ফুটবলারও। প্রবীণ কোচ হয়ত কাউকে চিনতেও পারলেন না। তবু একজন গেলে হয়ত চিনতেও পারেন।
পি কে ব্যানার্জি, জানি আপনার শরীরও ভাল নেই। তবু প্লিজ, একটিবার বাগুইআটি থেকে ঘুরে আসুন। আপনার ভোকাল টনিক দিয়ে একটু হলেও উজ্জীবিত করে আসুন আপনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে। বাঙালি শুধু আপনাদের ঝগড়াটাই দেখেছে। জীবনের পশ্চিম সীমান্তে এসে বিছানায় শুয়ে থাকা ওই প্রবীণের হাতে নিজের হাতটা রাখুন। দেখিয়ে দিন, সারাজীবনের একটা লড়াইয়ের রূপকথাও কীভাবে বন্ধুত্বের চেহারা নেয়।