বেঙ্গল টাইমসে শুরু হয়েছে নতুন বিভাগ— আত্মকথা। আজ ৩০ জানুয়ারি, গান্ধীহত্যার কলঙ্কিত দিন। এই দিনে যদি নাথুরাম গডসে তাঁর আত্মকথা লিখতেন, কেমন হত? সেই ভাবনা থেকেই এই লেখা। লিখেছেন ময়ূখ নস্কর।।
ভারতের ইতিহাসে ট্র্যাজিক নায়ক বলে কেউ যদি থাকে, তবে সে হলাম আমি। এত বড় একটা কাজ করলাম, কিন্তু ঘরে বাইরে কোথাও সম্মান পেলাম না। কংগ্রেসিরা আমাকে সম্মান দেবে না এটা জানা কথা। বাজপেয়ি অকংগ্রেসি হলেও ধর্মনিরপেক্ষ, উদার সাজার ব্যামো ছিল। ওকেও হিসাবের বাইরে রাখলাম। কিন্তু ও বাবা নরেন, তুইও আমাকে ভুলে গেলি বাবা।
অথচ নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দেখবেন, এই জাতির প্রকৃত জনক হলাম আমি। সুভাষচন্দ্রর জ্ঞানগম্যি ছিল না তাই গান্ধীকে জাতির জনক বলে ডেকেছিল। আচ্ছা, এই দেশের একটা লোককেও দেখে মনে হয়, তারা গান্ধীর সন্তান? অথচ ৯০ শতাংশ মানুষ এক্কেরে আমার কার্বন কপি। ধরুন পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে ছাদ ঢালাই হবে। মাস্টাররা চাঁদা চাইতে এল। অনেক কচলাকচলির পর ৫০ কী মেরেকেটে ১০০ টাকা চাঁদা দিই। কিন্তু পাড়ার দাদা যখন গণেশ পূজার চাঁদা তুলতে এসে, “আব্বে গাণ্ডুর বাচ্চা উদগাণ্ডু” বলে ১০০০ টাকার বিল ধরিয়ে যায়, সুড়সুড় করে দিয়ে দিই।
এই মেরুদণ্ডহীনতা তথা ধান্দাবাজির জনক হলাম আমি এবং আমার দল। আমরা কখনও ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটাও গুলি ছুঁড়িনি। গুলি খাওয়া তো দূরের কথা। দেশ স্বাধীন হল। তারপর মনে হল একটা গুলি ছোঁড়া দরকার। তাও বেছে বেছে এমন একটা লোককে, যার কাছে একটা ভোঁতা ব্লেডও থাকে না। দেহরক্ষীও থাকে না। পাল্টা মার খাওয়ার কোনও রিস্ক নেই। তাও আবার লোকটা তখন প্রার্থনা করতে যাচ্ছিল। সামনাসামনি লড়তে যায় ভগত, সুভাষের মতো মুখখুরা। সামনাসামনি গুলি খায় মাতঙ্গিনীর মতো গোমুখখুরা। আমরা সেয়ানা। যে লড়তে চায় না, যে নিরস্ত্র, তাকেই গুড়ুম।
একেই বলে বীরত্ব বুঝলেন, একেই বলে বীর। সৈন্যদল গড়ে লড়তে যাওয়ার অনেক হ্যাপা। লোককে অহিংস সত্যাগ্রহ বোঝানো আরও হ্যাপা। তার থেকে এ হল সহজে নাম ফাটানো। হ্যাঁ ফাঁসি যাওয়ার রিস্ক আছে। কিন্তু আমার গুরুরা বলেছে এই কাজ করলে আমি ডাইরেক্ট স্বর্গে যাব। ঠিক যেমন আজকের দিনে লাদেন, হাফিজ সইদরা বলে।
কিন্তু এত বড় একটা কাজ করে আমি কী পেলুম। যতদিন দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা নামক ন্যাকামো আছে ততদিন সরকার আমাকে সম্মান দেবে না জানি। কিন্তু সংঘ? রাহুল গান্ধী বলল, “আর এস এস গান্ধীকে মেরেছে।” অমনি রাহুলের নামে মামলা করে দিল। কেন? আমি কি এতটাই অচ্ছুৎ যে আমাকে কেউ স্বীকার করে না? আমি কি শুধু কাজের বেলায় কাজি?
এইবার আসি নরেনের কথায়। সবার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু স্বচ্ছ ভারতের লোগোতে যখন গান্ধীর চশমা দিল, তখনই মনটা কু গেয়েছিল। কেন? আমার বন্দুকটাকে লোগো করলে কী ক্ষতি হত? এই বন্দুক দিয়েই তো শান্তি, অহিংসা, ক্ষমা ইত্যাদি আবর্জনাগুলোকে স্বচ্ছ করেছিলাম।
তারপর যখন নোট বাতিল করল, ভাবলাম নতুন নোটে নিশ্চয়ই গান্ধীর বদলে আমার ছবি থাকবে। ও হরি! তা তো করলই না উল্টে চরকা কাটতে বসে গেল। ব্যাটা ভণ্ড! কেন, হাতে বন্দুক নিয়ে বিড়লা হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে, সেই ছবি ক্যালেন্ডারে ছাপতে পারলি না? জাতির অকৃতজ্ঞতা দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাই।
সব থেকে অবাক হয়েছিলাম অবশ্য, সেই ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। টেকো বুড়োটাকে গুলি করার পর। আমাদের নীতিই হল, মারের বদলে মার। পাল্টা মার দিতে না পারলেও পাল্টা খিস্তি তো দেবই দেব। কিন্তু ওই লোকটা গুলি খাওয়ার পরেও একটাও বাজে কথা বলল না। শুধু মৃদুস্বরে একবার ঈশ্বরের নাম নিল। সেই মুহূর্তে নিজেকে জরা বলে মনে হয়েছিল। জরাকে চেনেন তো? একজন ব্যাধ। সে শ্রীকৃষ্ণকে তীর মেরে হত্যা করেছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাকে অভিশাপ দেননি। বরং আশীর্বাদ করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ নাকি যুগে যুগে ফিরে আসেন? কোন রূপে আসেন? শুধু কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ রূপে? না কি অন্তিম মুহূর্তের ক্ষমাশীল রূপেও আসেন? আচ্ছা বেঁচে থাকলে উনি কি আমাকে ফাঁসির হাত থাকে বাঁচিয়ে দিতেন? আপনারা কেউ জানেন? বলুন না উনি কী করতেন? বলুন না উনি আসলে কে?
(আত্মকথা বিভাগটি নতুন শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই বেশ ভাল সাড়া পড়ে গেছে। চাইলে আপনারাও এই আত্মকথা লিখতে পারেন। আত্মকথা সিরিজের কয়েকটি লেখা পড়ুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, কেমন লেখা চাওয়া হচ্ছে। আনপার মৌলিক ভাবনা বেঙ্গল টাইমসকে আরও সমৃদ্ধ করুক। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com)