কয়েকদিন আগের কথা। অমল দত্ত তখন গুরুতর অসুস্থ। সেই সময়েই মোহনবাগান রত্ন হিসেবে ঘোষণা হয় সৈয়দ নঈমুদ্দিনের নাম। নঈমের বয়ানে মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্রকে সুন্দর চিঠি লিখেছিলেন ময়ূখ নস্কর। দাবি ছিল, আমাকে নয়, এবার মোহনবাগান রত্ন দেওয়া হোক অমল দত্তকে। সেই লেখা আবার প্রকাশ করা হল। যাঁরা তখন পড়েননি, তাঁরা এখন অবশ্যই পড়ুন।
ডিয়ার মিস্টার মিত্র,
আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব জানি না। মোহনবাগানের মতো ক্লাব আমাকে তাদের রত্ন হিসাবে বেছে নিয়েছে, এটা যে কত বড় সম্মানের, তা খেলোয়াড় মাত্রেই জানে। এর আগে আমি অর্জুন পুরস্কার পেয়েছি, দ্রোণাচার্য পুরস্কার পেয়েছি, মোহনবাগান রত্ন সম্মানকে আমি এদের সঙ্গে এক আসনেই রাখব।
সত্যি কথা বলতে কী খবরটা শুনে আমি প্রথমে বিশ্বাসই করিনি। মোহনবাগানে খেলেছি, কোচিং করেছি, কিন্তু সেই অর্থে ঘরের ছেলে তো কখনও ছিলাম না। বরং কোচ হিসাবে ইস্টবেঙ্গলকে ত্রিমুকুট দিয়েছি। যখন দ্রোণাচার্য হই, তখন আমি ইস্টবেঙ্গলের কোচ। তারপর ভাবলাম, মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব। তাদের মানসিকতা অনেক উদার। তাই আমার সাফল্যকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ঘরের ছেলে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আপনাদের ধন্যবাদ।
আপনাদের সঙ্গে আমার কত ঝামেলাই না হয়েছে অঞ্জনবাবু। আপনারা আমাকে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে হাতে চিপসের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছেন। পরে বলেছেন, কাল থেকে আর কোচিং করানোর দরকার নেই। আমি বেশি সময় ধরে অনুশীলন করাতাম, একটা ঘণ্টা বেঁধে দিয়েছিলাম, তা নিয়েও ক্লাবে অশান্তি হয়েছে। কিন্তু সেই সব পুরানো কথা আপনারা মাথায় রাখেননি। আপনাদের ধন্যবাদ।
কিন্তু তারপরেই মনে হল, আমার থেকে সিনিয়র কত খেলোয়াড়, কোচ মোহনবাগানের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা রত্ন পাওয়ার দাবিদার। তাঁদের ছেড়ে আমাকে কেন? নিজেই নিজেকে উত্তর দিলাম। মোহনবাগানের ইতিহাস এতই দীর্ঘ যে সিনিয়রিটির বিচার করতে গেলে, জীবিত ব্যক্তিরা কোনওদিনই সম্মান পাবেন না। সবাইকে মরণোত্তর মোহনবাগান রত্ন দিতে হবে। তাই আমাকে এবার সম্মান জানানো হচ্ছে।
কিন্তু এই কথাটা মাথায় আসতেই নিজেকে ধিক্কার দিলাম। এ আমি কী ভাবছি? যদি জীবিত কোনও ব্যক্তিকে সম্মান দিতে হয়, তাহলে আমি কেন ? অমল দত্ত এখনও বেঁচে আছেন। তিনি তো আমারও গুরু। আমি যদি অর্জুন হই, দ্রোণাচার্য হই, তিনি তাহলে প্রপিতামহ ভীষ্ম। তিনি থাকতে আমি কী করে এই সম্মান গ্রহ্ন করব ? শিষ্য
কখনও গুরুর ওপরে উঠতে পারে? আমি সারা জীবন ডিসিপ্লিন মেনেছি। এক্ষেত্রেও মানব। আগে অমল দত্ত সম্মান পাবেন। আমি না হয় পরের বছর পাব।
হয়ত বলবেন, নয়ের দশকে দ্রোণাচার্য পাওয়ার সময় কেন এই কথা বলিনি। তখন বয়স অনেক কম ছিল। এতকিছু তলিয়ে ভাবার মতো সময়ও ছিল না। ভেবেছিলাম, আমার সেই বছরের কাজের জন্য দেওয়া হল। সত্যিই, সেবার আমি ত্রিমুকুট এনে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ তো সত্তর পেরিয়ে এসেছি। এখন তো বুঝতে পারি, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল।
অমল দত্ত শুধু আমার থেকে সিনিয়র নন, আমার থেকে যোগ্য কোচও বটে। এটা স্বীকার করতে আমার কোনও গ্লানি নেই। রহিম সাহেব, অমল দত্ত, পি কে ব্যানার্জি এঁরাই ভারতের স্রবশ্রেষ্ঠ কোচ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। আমরা অনেকেই শারীরিকভাবে সুস্থ থেকেও কোচিং করানোর সুযোগ পাই না। কিন্তু পিকে-অমল কয়েক বছর আগেও কোচিং করিয়েছেন। প্রদীপদা আগেই এই সম্মান পেয়েছেন। তাছাড়াও তিনি অর্জুন, পদ্মশ্রী পেয়েছেন। কিন্তু অমলদা ? প্রাপ্য সম্মান কোথাও পাননি। না রাষ্ট্রের কাছে, না ফেডারেশনের কাছে, না ক্লাবের কাছে।
না অঞ্জনবাবু, অমল দত্তর আগে আমি মোহনবাগান রত্ন নিতে পারব না। আপনারা এবছর ওঁকেই সম্মান জানান। আমাকে সম্মান জানানোর অনেক সময় পাবেন। এবছর আমি আপনাদের থেকে অন্য একটা সম্মান চেয়ে নেব। প্রতি বছর তো কর্তারা মোহনবাগান রত্ন প্রদান করেন। এবার একটু অন্যরকম হোক। অমল দত্তর হাতে মোহনবাগান রত্ন আমি তুলে দিতে চাই। বলতে চাই, এ আমার গুরুদক্ষিণা। গুরুকে জানাই প্রণাম।
আমাকে এই সুযোগটা দিন না অঞ্জনবাবু।
ইতি, বিনীত
সৈয়দ নঈমুদ্দিন
{নঈমদা, জানি না এই লেখা আপনি পড়বেন কিনা। যদি পড়েন, লিখুন না এমন একটা চিঠি। মোহনবাগান রত্ন তো আপনি ভবিষ্যতে পাবেনই। কিন্তু এমন চিঠি লিখলে, ফুটবলপ্রেমী জনতা আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে। সেই সম্মানের তুলনা নেই। সবাই বলবে, হ্যাঁ ডিসিপ্লিন কাকে বলে, নঈম তা দেখিয়ে দিলেন।
লিখুন না এমন একটা চিঠি। }