স্মৃতিটুকু থাক
উত্তুরে হাওয়া দিলেই তার মন কেমন করে ওঠে। উত্তুরে হাওয়া বড় খারাপ। এ হাওয়া বয়ে আনে শুধু একরাশ প্রশ্ন। উত্তর দেয় না মোটে।
উত্তুরে হাওয়া দিলেই তার বুকের মধ্যে কেমন একটা দমচাপা কষ্ট হয়। তার মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার কথা। কংক্রিটের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দূরগামী হয়ে যায় চোখ।
ছেলেবেলায় আর কিছু থাকুক না থাকুক, রং ছিল হরেকরকম। পুকুরের কালো জলে ঘাই দিত রুপোলী কাতলামাছ। হাওয়ায় মাথা দোলাতো দিগন্তজোড়া হলুদ সর্ষেখেত। নির্মেঘ নীল আকাশের বুক চিরে উড়ে যেত সবুজ টিয়াপাখির ঝাঁক। এমনকী রোদ্দুরটা ছিল অবধি কমলা রঙের। সেই রোদে আরও মায়াবী লাগত লাল রঙের ক্যাম্বিস বলটা। বড়দা বলত, রাইট হ্যান্ড, রাউন্ড দ্য উইকেট। পিচের ওপর পড়ে সাঁই করে বাঁ দিকে মোড় নিত বলটা আর এক পা পিছিয়ে এসে মেজদা বলটা ঠেলে দিত স্কোয়্যারের দিকে। বাঁশবাগানের মাটিতে বিছিয়ে থাকা ধূসর পাতার ভিড়ে হারিয়ে যেত সে বলখানা।
সে অবাক হয়ে ভাবে, সেই লাল ক্যাম্বিস বলটার মতো কখন যে তার ছেলেবেলাটা হারিয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। আজকাল বড় বেশি ব্যস্ততা, বড় বেশি দায়িত্ব। নিজের জীবনের ওপর নিজেরই যেন কোনও অধিকার নেই। সাফল্য প্রতি মুহুর্তে গিলে খেয়ে নিচ্ছে ব্যক্তিগত পরিসরটুকু। তাই আচমকা কাজ ফেলে, মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায় সে। একবার, অন্তত একবার ফিরে যেতেই হবে ছেলেবেলায়।
ধুলো উড়িয়ে বাস ছুটবে লালমাটির রাস্তা ধরে। ভোর ভোর গিয়ে সে পৌঁছবে কুয়াশামাখা ফুলকপি খেতের সামনে। কিন্তু জমিতে পা দিতে গেলেই কে যেন পিছু ডাকবে, “কই যাও বাপ?”
ঘুরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে দেখবে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারকদাদু। মুখে তার সহস্র বছরের মায়াবী বলিরেখা। সে বলবে, “একটা ফুলকপি নেব তারকদাদু? শিশিরমাখা ফুলকপি?”
তারকদাদু হেসে বলবে, “নিবা তো বাপ। নিবা তো। খেতের ফসল তো হক্কলের। হুদু হাত পাওখান ধুইয়া লও।”
“হাত পা ধোব কেন তারকদাদু?”
“মাটির ফসল তো মায়ের দান। সে জিনিস নোংরা হাতে নিবা কেমনে? তোমার হাত পাও তো শহরের ধুলায় সকড়ি হইয়া আছে বাপ।”
সে চমকে ওঠে। নিজের দু’হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, সত্যি তো বড় ধুলো, বড় ধোঁয়া, বড় বেশি এঁটোকাঁটা। এ সকড়ি হাতে আর যাই হোক ছেলেবেলা মাখা যায় না।
(বেঙ্গল টাইমসের এক পাঠকের পাঠানো। লেখাটি আসলে কার, তিনিও জানেন না। শুধু ভাল লেগেছে, শেয়ার করেছেন। এমন সুন্দর লেখা লেখকের নাম ছাড়া সত্যিই অসম্পূর্ণ। তবু যদি কেউ হারানো ছেলেবেলা ফিরে পান, মন্দী কী!)