আজগুবি এক নিলাম, যেখানে যুক্তি, অঙ্ক, আবেগ কোনওটাই নেই

সোহম সেন

মেসি কি বার্সিলোনা ছাড়ছেন?‌ গেলে, কোথায় যাবেন?‌ গত বছর এই প্রশ্নটাকে ঘিরেই আন্দোলিত হয়েছিল ফুটবল দুনিয়া। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো যে হঠাৎ করে আবার ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে ফিরে আসবেন, অনেকেই ভাবতে পারেননি। কখনও পুরনো ক্লাব হয়ত সেই অর্থ বা মর্যাদা দেয়নি। আবার কখনও অন্য ক্লাব আরও আকর্ষণীয় আর্থিক প্যাকেজ গিয়েছে। মোদ্দা কথা, মেসি–‌রোনাল্ডোরা কোথায় যাবেন, সেটা নিজেরা ঠিক করেছেন। তাঁদের চুক্তির অঙ্ক কী হবে, তাঁরা নিজেরা ঠিক করেছেন। তাঁরা তাঁদের দর জানিয়েছেন। ক্লাব তাদের সামর্থ্য জানিয়য়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে হয়ত দর কষাকষিও হয়েছে। শেষমেশ, একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে।

কলকাতা ফুটবলের দলবদলের কথাতেও যদি আসেন, সেখানেও খেলোয়াড়দের নিজেদের ইচ্ছাই অগ্রাধিকার পেয়েছে। শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী বা সুব্রত ভট্টাচার্য ঠিক করেছিলেন, তাঁরা অন্য কোথাও যাবেন না। সবুজ মেরুনেই থাকবেন। আবার সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, গৌতম সরকার, প্রশান্ত ব্যানার্জি, কৃশাণু দে–‌রা কখনও এই দলে, কখনও ওই দলে। যখন যেখানে যেতে চেয়েছেন, গেছেন।

ক্রিকেটের লেখা লিখতে গিয়ে ফুটবলের এই চর্বিত চর্বন কেন?‌ তফাতটা বোঝাতে। মেসি–‌রোনাল্ডোদের যে স্বাধীনতা আছে, রবিচন্দ্রন অশ্বিন বা ঋদ্ধিমান সাহাদের সেই স্বাধীনতা নেই। তাঁরা ইচ্ছেমতো দল বাছতেও পারেন না। আবার ইচ্ছেমতো নিজেদের দরও ঠিক করতে পারেন না। নিলামে ঠিক হয় তাঁদের বাজার দর। সব দলের সামনে প্রথম চারজনকে আগাম বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল। সেই চারজনকে নিলামে তোলা হবে না। এই চারজনের ক্ষেত্রে তবু ফ্র‌্যাঞ্চাইজির সঙ্গে সেই ক্রিকেটারের কোথাও একটা আলোচনা বা রফার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম আলোচনার সুযোগটাও নেই। তাঁরা কোথায় যাবেন, কত দাম উঠবে, সবই কর্তাদের মর্জি।

ঋদ্ধিমান সাহা কেমন উইকেট কিপার, তাঁকে কলকাতার দলে নেওয়া যাবে কিনা, নিলামে সেটা ঠিক করেন শাহরুখ খানের পুত্র বা জুহি চাওলার কন্যা। আইপিএলে দশটা দল। সব দলেই অন্তত দু’‌জন করে উইকেট কিপার থাকার কথা। তার মানে, অন্তত কুড়ি জন উইকেট কিপার লাগার কথা। তারপরেও প্রথম দিন কিনা আনসোল্ড থেকে গেলেন ঋদ্ধিমান সাহা!‌ দ্বিতীয় দিন নিলামের শেষবেলায় আবার তাঁর নাম উঠল। ন্যূনতম আগ্রহটুকুও দেখাল না কলকাতার নামধারী কেকেআর!‌ মিনমিন করে নাম তুলল চেন্নাই। নম নম করে তুলে নিল গুজরাট। বেস প্রাইস ছিল এক কোটি। শেষমেশ নিলামে দর উঠল এক কোটি নব্বই লাখ। অথচ, আবেশ খানের বেস প্রাইস ছিল ২০ লাখ, দর উঠল দশ কোটি। শাহরুখ খানের বেস প্রাইস ছিল ৪০ লাখ, দর উঠল ন’‌কোটি।

এ এক আজব নিলাম। কোনও অঙ্ক মিলবে না। কোনও যুক্তি মিলবে না। কোনও আবেগও মিলবে না। সবকিছুই ঘেঁটে ঘ। যেখানে সুরেশ রায়না অবিক্রিত থেকে যান, কিন্তু শাহরুখের দাম ওঠে ৯ কোটি। যেখানে ডেভিড ওয়ার্নারের ভাগে জোটে সাড়ে ছয় কোটি, কিন্তু রাহুল তেওটিয়াকে কিনতে লাগে নয় কোটি। কেকেআরের কথাই ধরা যাক। হাতে পুঁজি ৪৮ কোটি। তার মধ্যে শুরুতেই শ্রেয়স আয়ারের জন্য ১২.‌২৫ কোটি, কামিন্সের জন্য ৭.‌৫ কোটি, নীতীশ রানার জন্য ৮ কোটি, শিবম মাভির জন্য ৭.‌২৫ কোটি। মোদ্দা কথা, এই চারজনের জন্যই খরচ হয়ে গেল পঁয়ত্রিশ কোটির ওপর। হাতে রইল পেনসিল। বাকি তেরো কোটিতে আরও অন্তত ১৫–‌১৬ জনকে তুলতে হবে। শুরুতেই লাগামছাড়া হওয়ার মাশুল দিতে হল। চোখের সামনে হাতছাড়া হলেন শার্দূল ঠাকুর, দীপক চাহার, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা, রাহুল ত্রিপাঠীরা। অল্প দর হেঁকেই হাত গুটিয়ে নিতে হল। তখন আর কোনও অঙ্কেই উত্তর মিলছে না। কোনও যুক্তিই কাজ করছে না।

যুক্তি বা অঙ্ক যেখানে কাজ করে না, সেখানে অন্তত আবেগকে আঁকড়ে ধরার একটা চেষ্টা থাকে। কিন্তু কেকেআরের সেই অ্যান্টেনাও যেন ভোঁতা। প্রথম দিনের নিলামে দলে কোনও উইকেট কিপার নেই। সুযোগ ছিল‌ দ্বিতীয় দিন ঋদ্ধিমান সাহাকে নিয়ে অন্তত কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করার। কিন্তু ঋদ্ধিমানের নাম যখন উঠল, কলকাতার বোর্ডে বসা কর্তারা কী নির্লিপ্ত রইলেন। যেন এই নামটা আগে শোনেনইনি। নেওয়া হল কাকে?‌ ইংল্যান্ডের শ্যাম বিলিংসকে। গত আইপিএলে যিনি ছিলেন দিল্লি ক্যাপিট্যালসে এবং একটি ম্যাচেও তাঁকে খেলানোই হয়নি। শেল্ডন জ্যাকসন, বাবা ইন্দ্রজিৎ কখনও ঋদ্ধিমানের বিকল্প হতে পারেন!‌ ঋদ্ধিমান ছাড়াও বাংলার আরও চারজন ছিলেন নিলামে। শাহবাজ আহামেদ ও আকাশদীপকে নিল আরসিবি। ঋত্বিক চ্যাটার্জি, ইশান পোড়েলকে নিল পাঞ্জাব কিংস। বাংলার এই চার ক্রিকেটারের ক্ষেত্রেও অদ্ভুত নির্লিপ্ত কেকেআর। অথচ, কুড়ি লাখের বেস প্রাইসেই তাদের পাওয়া যেত।

সব দলেই এমন বৈপরীত্ব ভুরি ভুরি। হাসারাঙ্গার দর ওঠে প্রায় এগারো কোটি। অথচ, রবিচন্দ্রন অশ্বিন পান দেড় কোটি। অজিঙ্কা রাহানে পান এক কোটি, অথচ ইশান কিষানের দর ওঠে ১৫.‌২৫ কোটি। উদাহরণ বাড়াতে চাইলে বেড়েই যাবে। এমন অসঙ্গতি এবারই প্রথম এমন তো নয়। যুক্তিহীনতার সেই ট্র‌্যাডিশন সমানে চলেছে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.