ছোট গল্পঃ বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণ

সুমন চৌধুরি

মাংসটা না ঠিক মতো সিদ্ধ হয়নি। খাসির মাংস যদি এরকম হয় ..।
—তা যা বলেছো। ফ্রায়েড রাইসটা কীরকম চাল চাল। আর এটা রাধাবল্লভি? ঠান্ডা ঠান্ডা চামড়া যেন। উফফ।
অজিতবাবু এবং সুখেনবাবু তাঁদেরই নিকট আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছেন। টেবিলের উল্টোদিকে বসেছে সৃষ্টি। সুখেনবাবুর মেয়ে। সে খাচ্ছে এবং চুপচাপ দুজনের মুখের কথা শুনছে। ইতিমধ্যে মেয়ের দাদা এলেন। টেবিলে টেবিলে গিয়ে ভদ্রতার খাতিরে সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘‌রান্না ভাল হয়েছে তো দাদা?’‌
একসময় এনাদের টেবিলেও এলেন। জিজ্ঞেস করলেন। হাসি মুখে উত্তর দিলেন সুখেন বাবু ,‘‌হ্যাঁ বাবা। রান্না ভাল হয়েছে।

সৃষ্টি অবাক। এই লোকটা এতক্ষণ তো কত কথাই না বলছিল। সৃষ্টি খেয়াল করল, মুখে যতই বলুক না কেন, দুজনে কিন্তু বেশ পেট পুরে খাচ্ছে। ভাত থেকে ফ্রায়েড রাইস, খাসির মাংস থেকে শুরু করে ইলিশ মাছ। তারপর ফিশ ফ্রাই এবং আরও যা যা আছে। খাসির মাংস সিদ্ধ হয়নি বলে ছেড়ে দিচ্ছে তা নয়। বা ফ্রায়েড রাইস চাল চাল ভাব থাকায় যে খাচ্ছে না তা নয় কিন্তু।

সৃষ্টি ভাবছে, তবে মানুষ এত দুমুখো হয় কীভাবে? অবশেষে শেষ পাতে আইসক্রিম এবং পান এল। সৃষ্টি সেগুলো হাতে নিয়ে হাত ধুতে চলে গেল। সৃষ্টির বয়স এখন বাইশ। কথা বার্তা চলছে। মানে পাত্রের খোঁজ চলছে। অবশেষে পাত্র পাওয়া গেল সৃষ্টির জন্য। খুব ভাল ছেলে। কলকাতায় থাকে। সম্ভ্রান্ত পরিবার। ঋষি। বড় ব্যবসা আছে নিজের। ধীরে ধীরে সৃষ্টি আর ঋষির মেলামেশা বেড়ে উঠল। প্রতি সপ্তাহে দেখা করা, একে অপরকে গিফ্ট দেওয়া এসবের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে প্রেম জমে উঠল তাদের। সৃষ্টি বুঝতে পারল, তার এবং ঋষির ভাবনা চিন্তা প্রায় একই প্রকারের। বিভিন্ন বিষয়ে দুজনের একই মত থাকে। বিয়ের দিন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। সৃষ্টি কয়েকদিন ধরে যেন একটু চিন্তায় পড়েছে। ওর মা ভাবল, মেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে, তাই হয়তো একটু চিন্তায়। কিছুদিন মেয়ের এরকম অবস্থা দেখে সুখেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘‌কী হয়েছে মা তোর? ‘‌সৃষ্টি একটু ভেবে বলল, ‘‌বাবা, কোনও আত্মীয়কে আমার বিয়েতে ডেকো না প্লিজ।’

 


‌—মানে?
—আমি ঋষির সঙ্গে কথা বলেছি। ও ও রাজি। কোনও আত্মীয়কে ডেকো না। মন্দিরে বিয়ে করবো। আর তাতে খরচ কম হবে।
— তোকে খরচের চিন্তা করতে হবে না মা। তোর বাবা আছে তো ?
— বাবা, তোমার মেয়ের সব আবদার রেখেছো সবসময়। এরপর তো অন্য কারোর বউ হয়ে যাব। হ্যাঁ, তোমার মেয়ে থাকব অবশ্যই। কিন্তু তখন আমার ওপর আরও একজনের অধিকার জমবে। তার আগে এই একটা শেষ আবদার। যে টাকাটা বাঁচবে সেই টাকায় সেই দিন মন্দিরের সামনের ওই গরিব মানুষগুলোকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দাও।
একটু ভেবে সুখেন বাবু বললেন,—আচ্ছা, তাই হোক। ভগবান জানে যে তুই আসলে কী চাস।
কথা মতো মন্দিরেই বিয়ে সম্পূর্ণ হল। মন্দিরের সমস্ত ভিখারি সেইদিন ভুরিভোজ সারলেন এবং দু হাত তুলে সৃষ্টি এবং ঋষিকে আশীর্বাদ করলেন। সৃষ্টি নিজে বিয়ের শেষে খাবার বেড়ে দিল। ঋষি হাত বাড়ালো। খাওয়ার শেষে সৃষ্টি এসে নিজের বাবাকে জিজ্ঞেস করল, এটাই ভাল। বলো বাবা?
—হ্যাঁ, সে ভাল। কিন্তু এরকম? আত্মীয়রা আসলেও বা কী হত?

সৃষ্টি হেসে বলল, তোমার সারাজীবনের আয় দিয়ে তুমি লোক খাওয়াবে আর ওরা এসে এক মুহূর্তে তোমার সমস্ত উপার্জনের একটা ইয়ার্কি বানিয়ে চলে যাবে। কেউ বলবে, —উহ। খাসির মাংসটা ঠিক সিদ্ধ হয়নি, বা রাধাবল্লভিটা একেবারে ঠান্ডা। তুমি বলতো বাবা, নিজের মেয়ের বিয়ের সময় এসব কথা যদি কানে আসে তখন কেমন লাগে? আর এমন নয় যে লোক খাবে না। খাবে। পেট পুরে খাবে আর তারপর এসব বলবে। তার থেকে বরং ওদের দেখো। ওই হাসিটাতেই যেন আমার বিয়ের সার্থকতা।

সুখেনবাবু একটু লজ্জা পেলেন বটে। কিন্তু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‌কেন জানি না, আমার এখন ইচ্ছে করছে তোকে আজীবন আমার কাছে রেখে দিই। আগলে রাখি তোকে। কিন্তু বাবা তো। নিজের সুখের আগে মেয়ের সুখ দেখব। মন দিয়ে সংসার করিস মা। তোর শ্বশুরবাড়ি খুব ভাগ্যবান। তোর মতো একজন কে বউ হিসেবে পেয়েছে।’‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.