‌সংসদের সেই দৃপ্ত কণ্ঠস্বর

বাংলার দিকপাল সাংসদরা যখন কথা বলতেন, গোটা সংসদ তখন যেন মুগ্ধ শ্রোতা। অতীত দিনের সেইসব দিকপাল সাংসদদের নিয়ে বিশেষ সিরিজ। এবারের শ্রদ্ধার্ঘ্য গুরুদাস দাশগুপ্তকে। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ড. অরিন্দম অধিকারী।

 

ভোট লুঠ কীভাবে করতে হয়, তা বোধহয় কেশপুরের সরুই গ্রামের থেকে আর কেউ ভাল জানে না! ২০০০ সালের ৫ জুন সরুই গ্রামে আপনাকে ভোটের দিন ঢুকতে দেয়নি সেই কুখ্যাত রফিক। ওই বুথে মাত্র ২ টি ভোট পেয়েছিল কাস্তে ও ধানের শীষ চিহ্ন। গণতন্ত্রের বেলাভূমি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল সেদিন। রাজনীতিতে একটা স্লোগান হয়ে গেল, ‘‌পাঁশকুড়া লাইন’‌। পাঁশকুড়া তখন যেন জহ্লাদের উল্লাসমঞ্চ। সারা রাজ্যে এই এই রাজনীতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার ডাক। ছাত্র নেতা জুলফাই মল্লিক–‌সহ শত শত মানুষের গণকবর খুঁড়েছিল প্রতিক্রিয়াশীলরা। শহিদ মহেন্দ্র দলুইয়ের কন্যা পুচনের কান্না ভেজা রাস্তায় দাপিয়ে বেড়িয়ে কেশপুরকে সেদিন শেষপুর করতে চেয়েছিল রাজনীতির লুম্পেনরা। ১৯৯৮ থেকে ২০০০-এই দু’‌বছরের অস্থির সময়ে এহেন এক মুক্তাঞ্চলে আপনি পাঁশকুড়া লোকসভার উপনির্বাচনে লড়তে এসেছিলেন। পরাজিত হলেন শ্বেত সন্ত্রাস আর হলুদ সাংবাদিকতার সামনে।

তারপর অবিভক্ত মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার মানুষ সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর রূপকথার লড়াই রচনা করলেন। আগেও রাজ্যসভায় ছিলেন। দেশের অন্যতম সফল সাংসদের গরিমা আগেই আপনার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে। তবু লোকসভা মানে সরাসরি মানুষের কণ্ঠস্বরকে আরও দৃপ্তভাবে পৌঁছে দেওয়া। ২০০৪ সালে পাঁশকুড়ার (‌তখনও লোকসভা কেন্দ্রের নাম ছিল পাঁশকুড়া)‌ মানুষ আপনাকে সংসদে বাঙ্ময় হতে পাঠালেন। দুর্নীতির চক্রব্যূহকে খানখান করে তাকে নির্মূল করে রাজনীতির পঙ্কিল খাতে আপনি লাল শালুক ফোটাতেন। হরিয়ানার গুরগাঁও এর শ্রমিক মহল্লা থেকে পাঞ্জাবের কোল খালি হয়ে যাওয়া মায়ের চিবুক বেয়ে ঝরে পড়া চোখের জলে লড়াইয়ের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠতেন আপনি। আপনার মতো সাংসদের লড়াই কখনও বরাক উপত্যকায় বিহু হয়ে বন্দিত হত, তো কখনও জলন্ধরের শতদ্রু নদীর তীরে কোনও গাঁয়ে লোহরি হয়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বালাত।

আপনি থেকে যাবেন পাঁশকুড়ার জানাবেড় কিংবা মঙ্গলদ্বারী গ্রামে ফুলচাষিদের ফুল সংরক্ষণের লড়াইয়ে। পাঁশকুড়া মডেল স্টেশন থেকে ডেবরার বালিচক উড়ালপুলের অনুমোদনের সফল রূপকার হিসেবেও আপনার ভূমিকা চিরদিন উজ্জ্বল থেকে যাবে। সংসদে যখন আপনি বলতেন, তখন বিরোধীরা হট্টগোল করতেও লজ্জা পেত। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে গোটা ক্যাবিনে, বিরোধী বেঞ্চ মুগ্ধ হয়ে শুনতে আপনার লড়াইয়ের কথা। আর টিভির পর্দায় চোখ রাখতেন আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ। আসলে ঘাটালের মানুষকে যখন জিজ্ঞাসা করত তোমাদের এম পি কে? তখন তারা উত্তর দিত কর্পোরেটের ত্রাস আর নিপীড়িত জনগণের জোরালো কণ্ঠস্বর কমরেড গুরুদাস দাশগুপ্ত।

লাল শোয়েটার পরিহিত নেতা দিল্লির কুয়াশা মাখা সকালে পার্লামেন্টের সামনে যখন এসে দাঁড়াতেন, তখন সংসদের নিম্নকক্ষ মনে মনে বলত ঘাটাল–‌সহ ভারতের গরিব মেহনতির দাবি আদায়ে আমি এবার সরগরম হব। কমরেড গুরুদাস দাশগুপ্ত, আপনাকে আজও মিস করে ঘাটাল।

‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.