সরল বিশ্বাস
এই তো সেদিন, চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন ডলি রায়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কে এই ডলি রায়? উত্তর হল,
এশিয়ার প্রথম মহিলা টি টেস্টার। চায়ের দুনিয়ায় বেশ পরিচিত নাম। কিন্তু বাঙালি সেভাবে খোঁজ রাখেনি। এই ডলি রায়ের আরও একটা পরিচয় আছে। সেটা বললে হয়তো অনেকে চিনবেন। তিনি ছিলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের স্ত্রী।
ঢাকুরিয়ার দক্ষিণাপণে ডলি রায়ের চায়ের একটি বিপণি ছিল। চা চা চা নামে একটি উৎসব করতেন। সমাজের নানা স্তরের অতিথিরা আসতেন। সৌগত রায় অনেকবার সেখানে জ্যোতি বসুকে নিমন্ত্রণ করেছেন। নানা কারণে জ্যোতি বাবুর যাওয়া হয়নি। একবার সৌগতবাবু নাছোড়বান্দা। জ্যোতিবাবুকে দিয়েই উদ্বোধন করাবেন। জ্যোতিবাবু এবার রাজি হয়ে গেলেন।
উদ্বোধনের পর গোটা প্রদর্শনী ঘুরিয়ে দেখানো হল। কোন চায়ের বিশেষত্ব কী, কোন চা কোন দেশে রপ্তানি হয়, কোন দেশে কোন চায়ের কেমন কদর, কত দাম, এসব বলা হল। পরে ছিল ছোট্ট একটি অনুষ্ঠান। সেখানে অভিনব একটি ভাষণ দিয়েছিলেন জ্যোতিবাবু। জানি না, এর কোনও রেকর্ডিং আছে কিনা। ডলি রায়ের কাছে হয়তো ছিল। তবে, স্মৃতি থেকে কিছুটা উদ্ধার করতে পারি। মনে হল, বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা যায়। জ্যোতিবাবু কতটা রসিক এবং কতটা অকপট স্বীকারোক্তি তিনি করতে পারেন, তা কিছুটা বোঝা যাবে।
শুরুতে যেমন ভূমিকা থাকে। তারপরেই এলেন মূল বিষয়ে: এখানে সৌগতবাবু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেককিছু দেখালেন। কোন চা ইউরোপে যায়, কোনটা আমেরিকায় যায়। কিন্তু উনি বললেন না, এটা পুরুলিয়ায় যায়, এটা মেদিনীপুরে যায়। বাংলার মানুষেরা কি চা খায় না? আমি তো রাস্তার ধারে লাইন দিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তারা নাকি চা খায়। ভিখারিরাও চা খায়। কিন্তু সৌগতবাবুরা সব চা–ই দেখছি বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এটা তো ঠিক নয়। এখানকার মানুষের জন্যও তো চা তৈরি করতে হবে। সব বিদেশে পাঠিয়ে দিলে হবে!
উনি বললেন, এটা হাজার টাকা কেজি, এটা দু হাজার টাকা কেজি। আমাকে এসব বুঝিয়ে কাজ নেই। আমিও নানা জায়গায় যাই। শুনেছি, দামী চা দেওয়া হয়। কিন্তু হাজার টাকার চায়ের সঙ্গে দু হাজার টাকার চায়ের কী তফাত, আমি বুঝি না। ওনার স্ত্রী নিশ্চয় বোঝেন। কিন্তু আমার তো মনে হয়, সব চা গুলোই একই, শুধু প্যাকেট গুলো আলাদা।
একবার লন্ডনে হোটেলে সকালে চা খাচ্ছি। ম্যানেজার দেখলাম, দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলবে। আমি তাকালাম। ম্যানেজার বলল, স্যার, এটা ফেমাস দার্জিলিং টি। ওই ছোকরা আমাকে দার্জিলিং চেনাচ্ছে। ও জানে না যে দার্জিলিংটা পশ্চিমবঙ্গে আর আমি সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী। ও জানুক আর না জানুক, বিদেশির মুখে দার্জিলিং চায়ের সুনাম শুনে ভাল লাগল। বেশ গর্বই হল। কিন্তু দার্জিলিং চা খেতে আমাকে লন্ডন যেতে হবে কেন? এখানে কেন পাব না? আজ বুঝতে পারছি, এই সৌগতবাবুরা সব চা–ই বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
হ্যাঁ, এই ছিল ভাষণের নির্যাস। বাকিরা ইংরাজিতে বললেও জ্যোতিবাবু সেদিন পরিষ্কার বাংলাতেই বলেছিলেন। বাকিরা চায়ের জগতের দিকপাল। চা সম্পর্কে তাঁদের বিস্তর জ্ঞান উগরে দিচ্ছিলেন। জ্যোতিবাবুও চাইলে সেক্রেটারিকে দিয়ে চা নিয়ে একটা জ্ঞানগর্ভ ভাষণ তৈরি করে আনতে পারতেন। চায়ের বাণিজ্য, চা শিল্পের সম্ভাবনা, সঙ্কট, সরকারি পরিকল্পনা–এসব নিয়ে নিজের ঢাক পেটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেই রাস্তাতেই গেলেন না। একেবারে সহজ–সরল, সাদামাটা ভাষায় নিজের অনুভূতি তুলে ধরলেন। বলাই বাহুল্য, তাঁর কাছে সবাই সেদিন ম্লান। শুধুমাত্র সরলতা এবং অকপট স্বীকারোক্তির জন্যই তিনি বাকিদের থেকে আলাদা। তাঁর দলের আর কাউকে এত সহজ ভাষায় কথা বলতে শুনিনি।