সরল বিশ্বাস
একজন ফুটবল সাংবাদিকের সবথেকে বড় স্বপ্ন কী? এদিক–ওদিক ভেবে লাভ নেই। সবাই চান, বিশ্বকাপ কভার করতে। নইলে, অনেককিছুই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
কিন্তু শুধু কভার করলেই তো হল না। শুধু বিমানের টিকিট কেটে বিমানে চেপে পড়লেই তো হল না। শুধু প্রতিনিয়ত ফেসবুকে ছবি সাঁটিয়ে নিজের উপস্থিতি জাহির করলেই তো হল না। একটা নিবিঢ় প্রস্তুতি লাগে।
এখনকার সময়ে, যখন হাতের মুঠোয় গোটা বিশ্ব, তখন প্রস্তুতি নেওয়াটা অনেক সোজা। কিন্তু নয়ের দশকে ছবিটা তেমন ছিল না। ইন্টারনেট নামক শব্দটা তখনও বাঙালির অভিধানে ধরা দেয়নি। গুগল, ইউটিউব তখন কালের গর্ভে। ফলে, তখন প্রস্তুতি নেওয়া মানে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাগাজিনে চোখ রাখা।
কলকাতার ডেকার্স লেন ভারতীয় সাংবাদিকতার আঁতুড়ঘর। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল হিকির বেঙ্গল গেজেট। এখনও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকার ঠাঁই এই ডেকার্স লেনে। নানারকমের বিচিত্র ম্যাগাজিন সেখানে এখনও পাওয়া যায়। কিন্তু ওয়ার্ল্ড সকার আসত না।
তাহলে উপায়? ধরলেন এক পরিচিত লোককে। যেভাবেই হোক, প্রতি সংখ্যার ওয়ার্ল্ড সকার চাই। প্রতি সংখ্যায় নিয়ম করে আসতে লাগল ওয়ার্ল্ড সকার। তিনি পড়তে লাগলেন, বুঝতে লাগলেন, শিখতে লাগলেন।
তিনি মানে, অরুণ সেনগুপ্ত। ততদিনে ক্রীড়া সাংবাদিকতার আঙিনায় দেড় দশক হয়ে গেছে।
মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে বেশ পরিচিত নাম। খেলোয়াড়দের পরম বন্ধু। ডুরান্ড, রোভার্স, সন্তোষ ট্রফি, ফেডারেশন কাপ— এমন অনেক টুর্নামেন্ট কভার করা হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বকাপ তো দূর গ্রহের তারা। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে তেমন যোগসূত্র তো গড়ে ওঠেনি। মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গল কভার করার অভিজ্ঞতা দিয়ে আর যাই হোক, বিশ্বকাপ হয় না। এই সহজ সত্যিটা তিনি নিজে সবথেকে ভাল বুঝতেন। তাই বিশ্বকাপের অন্তত দু’বছর আগে থেকে ঠিক করে নিলেন, যেতে হলে প্রস্তুতি নিয়েই যাবেন। এবং সেটা শেষবেলার প্রস্তুতি নয়। অন্তত দু’বছর আগে থেকে প্রস্তুতি চাই।
হুগলির কোন্নগরে ওয়ার্ল্ড সকার আসা শুরু হল। কিন্তু ক্লাস টেনের ছাত্রকে যদি হঠাৎ করে এমএসসি–র বই ধরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শুরুতে তালগোল পাকিয়ে যাওয়ারই কথা। এত মোটা বই, যার পুরো বিষয়টাই অজানা। হজম করাই কঠিন। শুরুতে যে হীনমন্যতা আসেনি, এমনও নয়। অনেককিছুই মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেত। বুঝতে না পারলে একে–তাকে জিজ্ঞেস করতেও সঙ্কোচ ছিল না।
কোন তারকা কোন ক্লাবে খেলছে। গোকূলে কে বেড়ে উঠছে। কার চোট কতখানি ভোগাতে পারে! কে ফর্মের পড়ন্ত বেলায়। কিন্তু আজ পড়লে তো কাল ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই শুধু পড়াটাই যথেষ্ট নয়। চর্চাটা আরও নিবিঢ় হওয়া দরকার। তাই প্রতি সপ্তাহে কোনও একটা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ একটা লেখাও দরকার।
শুরু হল সেই পর্ব। একদিকে, দৈনন্দিন মোহনবাগান–ইস্টবেঙ্গল, বাইচুং–বিজয়ন, পিকে–অমল দত্তদের নিয়ে লেখা। অন্যদিকে, রোমারিও–বেবেতো, বাতিস্তুতা–রিকলমেদের নিয়েও লেখা। ঘরের উঠোন আর সুদূর আকাশ যেন মিলেমিশে একাকার। নতুন ভাবনা, নতুন দৃষ্টিকোণ। তারপর অপারেশন ফ্রান্স। সেই শুরু। এরপর কখনও জাপান–কোরিয়া, তো কখনও জার্মানি। কখনও দক্ষিণ আফ্রিকা তো কখনও ব্রাজিল। বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজেকে সুন্দরভাবে মেলে ধরেছেন।
তখনও ফেসবুক ছিল না। নিজেকে জাহিরের তীব্র তাগিদও ছিল না। একে মফস্বল, তার ওপর বাংলা মাধ্যম। জন্মগত প্রতিভা নয়, ঘসে মেজে নিজেকে তৈরি করা। অশোক দাশগুপ্ত বা ধীমান দত্ত বা রূপায়ণ ভট্টাচার্যের মতো দুর্ধর্ষ লেখনি ছিল না। পার্থ রুদ্রর মতো এমন সাবলীল ইংরাজিও ছিল না। রূপক সাহা বা জয়ন্ত চক্রবর্তীদের মতো অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারও ছিল না। আসলে, অরুণ সেনগুপ্ত জানতেন, তাঁর সীমাবদ্ধতা কোথায়! তিনি জানতেন, তিনি কী পারেন। তিনি জানতেন, তিনি কী পারেন না। এই পরিমিতি বোধটা কজনের থাকে!
তাই ঘরের উঠোন থেকেই ডালপালা মেলে দিতে পেরেছিলেন বিশ্বকাপের সুদূর আকাশে। তাঁর মগ্নতা ফেসবুকে ছবি সাঁটানোয় নয়। তাঁর মগ্নতা দু’বছর আগে থেকে নিবিঢ় প্রস্তুতিতে। পরের প্রজন্ম যদি এই নিবিঢ় প্রস্তুতির কথা জানতেন! তাঁরা যদি একটু আড়াল বুঝতেন!