শিক্ষক দিবস হোক আত্মসমীক্ষার দিন

দিব্যেন্দু দে

শিক্ষক দিবস এলেই পুরনো সব স্মৃতি এসে ভীড় করে। আমাদের স্কুলে কীভাবে শিক্ষক দিবস পালন হত। কীভাবে আমরা শিক্ষকদের নানারকম উপহার দিতাম। তাঁরাও স্নেহ উজাড় করে দিতেন। সেইসব দিনগুলো বোধ হয় হারিয়েই গেল। এখন সকাল থেকে সোশ্যাল সাইটে নানা ছবি ঘুরে বেড়ায়। হোয়াটসঅ্যাপে কিছু দায়সারা গোছের ‘‌প্রণাম’‌ আসে।
আমিও একজন শিক্ষক। একথা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই, শিক্ষকদের যে সম্মান আমরা দিয়ে এসেছি, শিক্ষক হিসেবে সেই সম্মান আমরা পাই না। এর জন্য শুধু ছাত্রদের দায়ী করে লাভ নেই। মাঝে মাঝে নিজেদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। আমরা কি সত্যিই সেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য?‌
আমাদের মধ্যে অনেকেই আসি–‌যাই মাইনে পাই গোত্রের। দুটির বেশি তিনটি ক্লাস নিতে বললে আমরা অনেকেই বিরক্ত হই। অঙ্কের শিক্ষককে যদি বিজ্ঞানের ক্লাসে যেতে বলা হয় বা ইংরাজির শিক্ষককে বাংলার ক্লাসে যেতে বলা হলে হেডমাস্টারকে মুখের ওপর ‘‌না’‌ বলে দেন। বলেন, এটা আমার বিষয় নয়। অন্য কাউকে বলুন। কই, আমাদের সময় তো এমনটা ছিল না। একটা পিরিয়ড অফ যাচ্ছে। অন্য কোনও স্যার এসে দিব্যি পড়িয়ে যেতেন। এমনকী ইংরাজির শিক্ষককেও অঙ্কের ক্লাস নিতে দেখেছি। বা ফিজিক্সের শিক্ষক অনায়াসেই ইতিহাস পড়িয়ে চলে যেতেন। কেউ কেউ হয়ত নিজের বিষয়টাই পড়াতেন। এখন এমনটা ভাবাই যায় না।
আমাদের সময়েও স্যারেরা টিউশনি পড়াতেন। কিন্তু এটাও জানি, অনেক ছেলেমেয়েকে একেবারে বিনা পয়সাতেই পড়াতেন। এখনও যে এমনটা হয় না, তা নয়। তবে খুব কম। কেউ একশোজনকে পড়ালে হয়ত দুজনকে বিনা পয়সায় পড়াচ্ছেন। এবং সেটাও চারিদিকে বিজ্ঞাপন করে বেড়ান। পুজোর ছুটিতে, গরমের ছুটিতে স্যারেরা স্পেশ্যাল ক্লাস নিতেন। স্কুলে না গেলে খোঁজ নিতেন, কখনও অভিভাবকদের জানাতেন। সেই ভয়েই আমরা স্কুলে যেতাম।
আমাদের ছাত্রাবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। কিন্তু এখন এই সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যাচারে শিক্ষকরা নিজেদের সম্মান আরও বেশি করে হারাচ্ছেন। অনেক শিক্ষককে এমন এমন পোস্ট বা ছবি শেয়ার করতে দেখি, সত্যিই মাঝে মাঝে সংশয় জাগে, আমরা শিক্ষক!‌ এই জাতীয় ছবি দেখলে একজন ছাত্র কেন একজন শিক্ষককে সম্মান করবে?‌ আরও কী কী হয়, সেগুলো না হয় শালীনতার কারণে উহ্য রাখলাম।
আমাদের সারাদিনের আলোচনার বড় একটা সময় জুড়ে থাকে, ‘‌ডিএ’‌ পাচ্ছি না। কিন্তু যা পাচ্ছি, তার বিনিময়ে কী ফিরিয়ে দিচ্ছি, তা নিয়ে কখনই আলোচনা শুনি না। সত্যিই তো, লকডাউনের সময় বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মীরা দিনরাত কাজ করেছেন। তারপরেও অতি অল্প মাইনে পেয়েছেন। অনেকের চাকরি চলেও গেছে। আর আমরা!‌ কাজ না করেই পুরো মাইনে নিয়েছি। তারপরেও ‘‌আমরা কত বঞ্চিত’‌ বলে আক্ষেপ জুড়েছি। করোনার পর স্কুল খুলছে। আমরা স্কুলে যেতে কত অনীহা দেখিয়েছি। এমন ভান করেছি, যেন স্কুল খুললেই ছাত্রদের করোনা হয়ে যাবে। এই সময় সরকার কেন স্কুল খুলতে গেল?‌ আসলে, আমরা দুপুরের ভাত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি। দিব্যি স্কুলে না যাওয়া অভ্যেস করে ফেলেছিলাম। খামোখা কেন আবার স্কুলে যেতে হবে!‌ অনেকের মধ্যেই এমন মনোভাব টের পেয়েছি। সব শিক্ষক নিশ্চিতভাবেই এমন নন। ব্যতিক্রমী শিক্ষক অনেকেই আছেন। কিন্তু সত্যিই তাঁরা ব্যতিক্রমী।
‌হ্যাঁ, আমাদের সময়ে কেউ কেউ মারতেন। কিন্তু তাঁরাই আবার ভালওবাসতেন। তাই সেই বেতের আঘাত খেয়েও খারাপ লাগত না। বরং, এখন বুঝতে পারি, তার পেছনে কতটা স্নেহ লুকিয়ে ছিল। আমরা মারি না ঠিকই, কিন্তু ভালওবাসি না। তাই আমাদের কোনও আচরণ ছাত্রদের মনে কোনও ছাপ ফেলে না। তারাও স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে যায়, ভুলেও যায়। ঠিকই করে। কারণ, এই উপেক্ষাই আমাদের প্রাপ্য।
তাই শিক্ষক দিবস আমাদের একটু আয়নার সামনে দাঁড় করাক। এই দিনটা হয়ে উঠুক শিক্ষকদের আত্মসমীক্ষার দিন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.