অভিজিৎ দে
আশিতে আসার যে কী বিড়ম্বনা! শরীর কথা শুনতে চায় না। রোজ কোনও না কোনও কলকব্জা বিকল হয়ে পড়ে। স্মৃতি সঙ্গ দেয় না। চেনা নামগুলোও তখন কেমন যেন গুলিয়ে যায়। কানে কম শোনা, চোখে কম দেখা, এগুলো তো স্বাভাবিক উপস্বর্গ। বাড়ির কাছেও মানুষটা কেমন যেন বোঝা। সবাই এড়িয়ে চলে। পাড়া–পড়শীরা মৃত্যুর জন্য দিন গোনে।
কিন্তু এক ডুবে যদি বয়সটা কমে যেত। সব বার্ধক্যকে ঝেড়ে ফেলে যদি আবার সেই হারানো যৌবন ফিরে পাওয়া যেত! নিশ্চয় একটা বিশেষ সিনেমার কথা মনে পড়ছে! দেখতে দেখতে সেই ‘৮০ তে আসিও না’ ছবিটার পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৭ তে। এই বাঁকুড়ার সঙ্গে ছবিটার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। কারণ, ঝাঁটিপাহাড়ি, ছাতনা, শুশুনিয়াতেই হয়েছিল ছবির শুটিং।
একটা ট্রেনের দৃশ্য। কিংবদন্তি জুটি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়–জহর রায়। নামছেন ঝাঁটিপাহাড়ি স্টেশনে। সিনেমায় স্টেশনের নামটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। স্বপ্নে হাওয়া বদল করতে এসেছিলেন ভানুবাবু। চড়ে বসলেন এক ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়া নিয়ে গিয়ে ফেলল এক পুকুরে। ব্যাস, বয়স কমিয়ে, একেবারে ছোকরা হয়ে জল থেকে উঠে এলেন ভানু। তারপর সেই পুকুরের জল যেন অমৃতসমান। ব্ল্যাক হতে লাগল। দেশের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা এলেন পুকুরের জল নিয়ে গবেষণা করতে।
সেই পুকুরটা শুশুনিয়ায় আজও আছে। শীত এলেই কাতারে কাতারে পর্যটক। কত বাস দাঁড়িয়ে থাকে। কত ডিজে বাজে। কিন্তু কজন জানেন সেই পুকুরটার কথা? না, সেই পুকুরের তেমন কোনও অলৌকিক মাহাত্ম্য নেই। কিন্তু এখানেই সেই শুটিং, এটুকুই বা কজন জানেন? কোনও একটা ঝর্নায় মন্দাকিনী স্নান করেছিলেন বলে নাম হয়ে গেছে মন্দাকিনী ফল্স। সেটা পর্যটকদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয়। শুশুনিয়ার এই পুকুরকে ঘিরে তেমনটা করা যেতেই পারত। চারপাশে বেশ চেয়ার পেতে, একটু সৌন্দর্যায়ন করা যেত। পুকুরটার নাম দেওয়া যেত— ‘আশিতে আসিও না’। অন্তত কিছু মানুষ তো জানতেন, এখানেই হয়েছিল সেই ছবির শুটিং।
থাক সে কথা। আমরা বরং ফিরে যাই পঞ্চাশ বছর আগের সেই দিনগুলোয়। আরও একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখা যাক। এই ছবির প্রযোজক ছিলেন জোড়হিরার শিবপদ চট্টোপাধায়। নিজে অভিনয় করতেন, যাত্রানুরাগী মানুষ ছিলেন। অভিনেতা–কলাকুশলীদের অনেকেই ছিলেন শিবপদবাবুর আতিথেয়তায়। টুকরো টুকরো কত ছবি মনে পড়ে তাঁর স্ত্রী ছবিরানীর, ‘আমরা তখন একেবারেই ছোট। সবাইকে চিনতামও না। এখানেই রান্না হত। অনেকেই থাকতেন। গাড়িতে করে সবাই শুটিং করতে যেতেন। আমরাও গেছি। তখন এতকিছু বুঝতে পারিনি। পরে যখন সিনেমাটা দেখি, তখন মনে হত, এই লোকগুলো তো আমাদের এখানেই ছিলেন।’
ছবির পরিচালক ছিলেন শ্রী জয়দ্রথ। আর্টিস্ট তালিকা বেশ তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোই। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্টোদিকে রুমা গুহঠাকুরতা। ভানুর পার্টনার জহর রায় তো ছিলেনই। ছিলেন তরুণ কুমার, কমল মিত্র, অসিত বরণদের মতো তারকারাও। এবং অবশ্যই রবি ঘোষ। ততদিনে সবাই স্বনামধন্য। যদিও এই মফস্বল এলাকায় সিনেমা হল ছিল না। আর তখন টিভি নামক শব্দটাও বাঙালি শোনেনি। ফলে, তাঁরা দূর গ্রহের তারা হয়েই ছিলেন। এখনকার সময় হলে সেলফির বন্যা বয়ে যেত।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু ছিলেন ছাতনাতেই। উঠেছিলেন অরুণ দেওঘুরিয়ার বাড়িতে। সত্তরের কোঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা অরুণবাবুর মনে পড়ছে সেই দিনগুলো, ‘আমার তখন স্কুলজীবনের শেষের দিক। তখনই হয়েছিল এই ছবির শুটিং। আমার মামার বাড়ি ছিল কলকাতায়। মামাদের সঙ্গে ভানুবাবুর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদেই তিনি আমাদের বাড়ির অতিথি ছিলেন। উনি হোটেলে বা অন্য কোথাও থাকতে চাননি। মামাবাবুর কথায় এসেছিলেন আমাদের বাড়িতেই। আমরা তখন খুব একটা সিনেমা দেখতাম না। ফলে, কে কতবড় তারকা, ঠিক জানতামও না। তবু ভানুবাবুর নাম শুনেছি। তিনি খুব হাসাতেন, এটাও জানতাম। দিন সাতেক ছিলেন। সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। একদিন কামারকুলিতে শুটিং হয়েছিল। আমরা একদিন শুটিং দেখতে শুশুনিয়াতেও গিয়েছিলাম।’
তখন ভানুবাবুর সঙ্গে বিশেষ কোনও স্মৃতির কথা মনে পড়ে? বর্ষীয়াণ অরুণবাবু বলেন, ‘এমনিতেই আমরা তখন গ্রামের মানুষ, কিছুটা লাজুক। তার ওপর উনি এত বড় মাপের তারকা। তাছাড়া, আমরা তখন অনেকটাই ছোট। যা কথা বলার, বাড়ির বড়রাই বলতেন। তবে স্টারসুলভ কোনও অহঙ্কার ছিল না। সবার সঙ্গে বেশ সহজভাবেই মিশতেন ভানুবাবু।’
তখন বাঁকুড়ার হলে ছবিটা অনেকেই দেখতে গিয়েছিলেন। তারপর টিভিতে মাঝে মাঝেই ছবিটা দেখা যায়। ছবিরানী, অরুণবাবুরা তখন স্মৃতির সরণি বেয়ে হেঁটে যান সেই ফেলে আসা দিনগুলোয়। টুকরো টুকরো কত স্মৃতি ভিড় করে আসে। সত্যিই, দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল!