গালাগাল নয়, বায়রনকে বরং অভিনন্দন জানান

অজয় কুমার

বায়রন বলতেই এতকাল আমরা বুঝতাম এক ইংরেজ কবিতে। গড়পড়তা বাঙালি ইংরাজি কবিতা পড়ুক বা না পড়ুক, পাঠ্যপুস্তকের দৌলতে বা নানা আলোচনায় শেলি, কিটস, বায়রন কথাগুলোর সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই পরিচিত। কিন্তু গত দু–‌তিন মাস বায়রন শব্দটা আমবাঙালির কাছে যেন অন্য এক পরিচিতি নিয়ে হাজির হয়েছিল। গুগলে বায়রন লিখলেই এসে যেত বায়রন বিশ্বাস নামের এক যুবকের নাম। সঙ্গে এসে যেত সাগরদিঘি শব্দটা। রাজনীতির পরিভাষায় যোগ হয়েছিল দুটো নতুন শব্দবন্ধ— ‘‌সাগরদিঘি মডেল’‌।

এই বায়রনের নাম মাস তিন–‌চার আগেও বাঙালি শোনেনি। এই নামে যে কংগ্রেসের কোনও নেতা আছেন, খোদ কংগ্রেসের লোকেরাই জানতেন না। কিন্তু একটা উপনির্বাচন যেন একেবারে সামনের সারিতে এনে দিল বায়রন বিশ্বাস নামটাকে। বিধানসভায় বামেদের কোনও প্রতিনিধি নেই। কংগ্রেসেরও ছিল না। সেখানে অন্তত একজন যদি বিধানসভায় ঢোকার ছাড়পত্র পান, তার একটা বাড়তি তাৎপর্য আছে বৈকি। তাছাড়া, সাগরদিঘির ফল তো নিছক একটা উপনির্বাচনের ফল ছিল না। অনেকগুলো বার্তা রেখে গিয়েছিল এই সাগরদিঘি। ১)‌ ঠিকঠাক লড়াই দিতে পারলে তৃণমূলকে হারানো যায়। ২)‌ সংখ্যালঘু ভোট মানেই তৃণমূলের একচেটিয়া নয়। যেখানে লড়াইয়ের ক্ষেত্র থাকবে, সেখানে তাঁরা তৃণমূলের বিকল্প ঠিক বেছে নেবেন। ৩)‌ এত হাজার লিড মানেই টেকেন ফর গ্র‌্যান্টেড নয়। মানুষ সুযোগ বুঝলেই সমীকরণ বদলে দিতে পারে। ৪)‌ তৃণমূলের বিকল্প মানেই বিজেপি নয়। মানুষ যেখানে তৃণমূল বিরোধী শক্তি বলে যাকে মনে করবেন, তাঁর ওপরই আস্থা রাখবেন।

কিন্তু যা হয়!‌ জয় করে তবু ভয় যায় না। এই মুহূর্তে তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা কত, তারা নিজেরাও জানে না। অন্তত ২২০ তো বটেই। এরপরেও বিরোধী দলের একজন জিতে গেলে, যেভাবেই হোক, তাকেও গিলে ফেলতে হবে। প্রলোভন দাও। তাতে কাজ না হলে কোণঠাসা করো। তাতেও কাজ না হলে হুমকি দাও। মোদ্দা কথা, ‘‌বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন এ জমি লইব কিনে।’‌ একজন বিরোধী জিতেছে?‌ তাকেও চাই। মোদ্দা কথা, আমার বিরুদ্ধে কথা বলার যেন কেউ না থাকে।

বেচারা বায়রন!‌ কতক্ষণ আর একা লড়াই করে যাবেন!‌ ভোটে জেতা এক জিনিস। কিন্তু বারো মাস প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়া আরেক জিনিস। থানার ওসি পাত্তা দিচ্ছে না। বিডিও ফোন ধরছে না। পাড়ার এলি–‌তেলি নেতারাও চমকে দিচ্ছে। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তুমি বিধায়ক হতে পারো, কিন্তু তোমার থেকে একটা পঞ্চায়েতের মেম্বার বা পাড়ার তৃণমূল নেতার ক্ষমতা অনেক বেশি। পুলিশ সেই পাড়ার তৃণমূল নেতার কথা শুনবে, কিন্তু তোমাকে পাত্তা দেবে না। বিডিও পঞ্চায়েত প্রধানকে দেখে উঠে দাঁড়াবে, কিন্তু তুমি গেলে সটান বলে দেওয়া হবে, ‘‌ব্যস্ত আছি, দেখা হবে না।’

‌আগেকার যুগে একটা কথা চালু ছিল, ধোপা নাপিত বন্ধ। এ অনেকটা সেরকম ব্যাপার। তুমি শাসকদলকে হারিয়ে জিতেছো?‌ অতএব, তোমার ধোপা নাপিত বন্ধ। দু’‌মাসেই বেচারা বায়রন যেন হাঁফিয়ে উঠেছেন। কে চায় এই দমবন্ধ করা আবহে থাকতে। তার থেকে বাবা পতাকা হাতে তুলে নাও। ‘‌অনুপ্রেরণা’‌য় সামিল হয়ে যাও। সেই ঢের ভাল। বায়রন ঠিক সেটাই করেছেন। নিজের এলাকায় কী করে আর অন্য দলের পতাকা তুলে নেন!‌ তার থেকে বরং ঘাটালে ছুটে যাওয়া অনেক ভাল। এলাকার লোকে যা জানার, টিভিতেই জানুক। বিক্ষোভ–‌টিক্ষোভ দু–‌একদিন থাকবে। দু–‌একদিন ফেসবুকে একটু খিল্লি হবে। তারপর সবাই ভুলে যাবে। কারণ, দলবদল এখন আর কাউকে অবাক করে না। রাগ বা ঘৃণা তৈরি করে না। সর্বগ্রাসী শাসকদলের দৌলতে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত লোকের দলবদল যখন বাঙালি নির্বিঘ্নে হজম করেছে, আরেকটা হজম করতেও বাঙালি সময় নেবে না।

অনেকেই বায়রনকে গাল পাড়ছেন। কেউ বলছেন গদ্দার, কেউ বলছেন মিরজাফর, কেউ বলছেন বিশ্বাসঘাতক। ঘুরে ফিরে সেই একই প্রতিশব্দ। শুধু শুধু বায়রনকে গালাগাল দিয়ে আর কী হবে?‌ তিনি তো নেহাত পরিস্থিতির শিকার। টাকার লোভে বায়রন দল বদল করেছেন বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, তিনি ব্যবসা করেন। শাসকদলকে চটিয়ে সেই ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। পদে পদে বাধা সৃষ্টি করতে সত্যিই এঁদের কোনও জুড়ি নেই। মিথ্যে কেস, মিথ্যে মামলা, হুমকি— এসব তো আছেই। মূলস্রোতে থাকলে অন্তত এসব ঝক্কি পোহাতে হবে না। এই নিশ্চয়তাটুকুই হয়ত তিনি চেয়েছিলেন। আর যদি মন্ত্রীত্ব বা কোনও পদ জুটে যায়, সেটা হবে বাড়তি পাওনা।

কিন্তু দলবদল করতে গিয়ে যুবরাজের পাশে বসে বায়রন কী বললেন, সেটা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বললেন, ‘‌বিরোধী বিধায়ক হয়ে কাজ করতে পারছিলাম না।’‌ ছোট্ট একটা কথা। আপাতভাবে খুবই নিরীহ। তাঁর কাজের পথে বাধাটা কে?‌ এমন তো নয় যে কংগ্রেস বা বিজেপি বা সিপিএম তাঁকে কাজ করতে দিচ্ছে না। বায়রন বুঝিয়ে দিলেন, এখানে বিরোধী বিধায়কদের ন্যূনতম পরিসরটুকু নেই। ন্যূনতম সম্মানটুকু নেই। প্রশাসন বিরোধী বিধায়ককে পাত্তাই দেয় না। পদে পদে হেনস্থা করে। খোদ যুবরাজের পাশে বসে বুঝিয়ে দিলেন রাজ্যটা আসলে কেমন চলছে।

তাই বায়রনকে গালাগাল নয়। বরং অভিনন্দন জানান। ভাইপোর পাশে বলে এমন নির্লজ্জ সত্যিটা বলতে পেরেছেন। সরকারের গালে এর থেকে বড় থাপ্পড় আর কী হতে পারে!‌ ‌

 

****************

বেঙ্গল টাইমসের ই ম্যাগাজিনে লেখাটি প্রকাশিত। এরকম আরও বেশ কিছু লেখা রয়েছে সেই পত্রিকায়। নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে সেই লেখাগুলি পড়তে পারেন।

https://bengaltimes.in/wp-content/uploads/2023/06/bengal-times…10-june-issue.pdf

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.