সরল বিশ্বাস
২০০২। গুজরাটে ভয়বাহ দাঙ্গা। খোদ বিজেপির ভেতরেই জোরালো দাবি উঠল, মোদিকে সরাতে হবে। ছোট খাটো বা মাঝারি মানের নেতারা এমন দাবি তোলেননি। মোদিকে সরানোর দাবি ছিল খোদ অটল বিহারী বাজপেয়ীর। সেদিন মোদির পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। বিনিময়ে কী চমৎকার প্রতিদানই না পেয়েছেন!
প্রতিবছর ক্যালেন্ডারে ১০ নভেম্বর তারিখটা আসে। নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহরা তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যান। ফুল দিয়ে আসেন। ছবি ওঠে। সেই ছবি সুকৌশলে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বোঝানো হয়, আদাবনিকে কতখানি শ্রদ্ধা করেন। আদবানির ৯৫ তম জন্মদিনেও তার ব্যতিক্রম হল না।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি মাঝে মাঝেই বলতেন, তিনি গুরুদক্ষিণা দিতে চান। কিন্তু গত সাত বছরে গুরুদক্ষিণার যা নমুনা দেখিয়েছেন, আদাবনির কাছে তা সত্যিই বেশ করুন। আজ বিজেপি নাকি বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। বিজেপিকে এই জায়গায় আনার পেছনে সবথেকে বেশি কৃতিত্ব কার? যে নামটা একেবারেই সামনের সারিতে উঠে আসব, তিনি লালকৃষ্ণ আদবানি। বাবরির ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু তারপর থেকে মূল্যবোধের রাজনীতিই করে এসেছেন। হাওলায় নাম ওঠায় সঙ্গেসঙ্গে পদত্যাগ করেছিলেন লোকসভা থেকে। বলেছিলেন, যতদিন না আদালতে নিষ্কলঙ্ক প্রমাণিত হচ্ছেন, আর ভোটে দাঁড়াবেন না।
সত্যি সত্যিই কথা রেখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রিত্বের ব্যাটন ছেড়ে দিয়েছিলেন বাজপেয়ীর হাতে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সৌজন্য হারিয়ে ফেলেননি। তিনিই দলের অন্যতম কাণ্ডারী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়ত অভিমানে দু–এক কথা বলেও ফেলেছেন। কিন্তু সেই অভিমান কি একেবারেই অনায্য? দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে তাঁকে ডাকা হয় না, ডাকলেও বলতে দেওয়া হয় না। কোথায় কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তাঁর মতামত নেওয়া হয় না। নামেই বহুকাল আগে একটা মার্গদর্শক মণ্ডলী গঠন করা হয়েছিল। আজ পর্যন্ত কোনও মার্গ দর্শন দেওয়া সুযোগ হয়েছে, এমন অভিযোগ নেই। মোদি–অমিত শাহরা যেভাবে তাঁকে উপেক্ষা করে চলেছেন, এই উপেক্ষা কি সত্যিই তাঁর প্রাপ্য ছিল?
২০১৭ সালে অনেকেই জানতেন, তিনিই সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি। দলের ভেতরেও এমন দাবি বেশ জোরালো ছিল। বিরোধীদের দিক থেকেও তেমন আপত্তি আসত বলে মনে হয় না। তিনি থাকতে অন্য কাউকে রাষ্ট্রপতি করা একটু কঠিনই হত। আবার তাঁকে রাষ্ট্রপতি মেনে নেওয়াও মুশকিল। নানা সময়ে নানা বাধা আসতে পারে। আর যাই হোক, তাঁকে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ রাষ্ট্রপতি বানানো যাবে না। এমন লোক রাইসিনা হিলসে বসলে মাঝে মাঝেই বিড়ম্বনা বাড়বে। সত্যিই তো, এমন লোককে মোদি–অমিত শাহরা চাইবেন কেন?
নিজেরা যেটা পারছিলেন না, সেটা সুপ্রিম কোর্ট করে দিল। চার্জশিটে নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হল আদবানির। সেই সুযোগে রামনাথ কোবিন্দকে করে দেওয়া হল রাষ্ট্রপতি। সত্যি করে বলুন তো, রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে কজন তাঁর নাম জানতেন! আবার যে চার্জশিট দেখিয়ে আদবানিকে আটকানো হল, রাষ্ট্রপতি ভোট পর্ব মিটতেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেখা গেল, সবাই বেকসুর খালাস। তাহলে সিবিআই এমন চার্জশিট দিয়েছিল কেন? সহজ কথা, সরকার চেয়েছিল, তাই। সরকারের সম্মতি ছাড়া চার্জশিটে আদবানির নাম রাখা সম্ভব ছিল?
বিচক্ষণ আদবানি অঙ্কগুলো বোঝেন না, এমন তো নয়। রাজনৈতিক সৌজন্য ও সংযম দেখিয়ে হয়ত নীরব আছেন। কোনও একদিন এই সংযম শিথিল হতেই পারে। গত সাতবছর ধরে শ্রদ্ধা জানানোর অনেক নাটক তিনিও দেখে আসছেন। দেখতে দেখতে বয়স ৯৫ হয়ে গেল। জানি না, কতদিন সুস্থ থাকবেন। যতদিন সুস্থ থাকবেন, এই নাটকটা মঞ্চস্থ হতেই থাকবে।
আর বর্ষীয়ান আদবানি একটা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। মনে মনে বলবেন, এমন গুরুদক্ষিণা সত্যিই আমার প্রাপ্য ছিল না।