ভিক্টরের পাল্লা কংগ্রেসের দিকেই ঝুঁকে

সরল বিশ্বাস

গত কয়েকদিন ধরেই একটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে, ভিক্টর এবার কী করবেন?‌

কী করবেন মানে কোথায় যাবেন?‌ তৃণমূলে?‌ নাকি বিজেপিতে?‌

সত্যিই এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন উত্তরবঙ্গের এই লড়াকু নেতা।

গতবছর বিধানসভা ভোটের কয়েকমাস আগে। বারবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন প্রশান্ত কিশোর। একদিন হঠাৎ করেই হাজির হয়ে গেলেন তাঁর কাছে। নানা কথার মাঝে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, আপনি তৃণমূলে যোগ দিন। বিনিময়ে আপনি তিনটি দপ্তরের নাম বলুন। এই তিনটি দপ্তরের মধ্যে কোনও একটি দপ্তরে আপনি শপথ নিন।

সেদিন ভিক্টর রাজি হননি। সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাবের কথা গোপনও রাখেননি। তাঁকে নিয়ে যেন কোনও ভুল বোঝাবুঝি না হয়, তাই প্রকাশ্যে এনেছিলেন। এতবড় একটা অভিযোগের পরও পিকের দিক থেকে কোনও রিজয়েন্ডার আসেনি। উল্টে ভিক্টরই তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন, যে রেস্তোরাঁয় বসে এই আলোচনা হয়েছিল, তার সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হোক। তাহলেই বোঝা যাবে, আমরা সেখানে কতক্ষণ বসেছিলাম।

শুধু তখনই নয়, তার আগেও নানা সময়ে তাঁর কাছে দলবদলের প্রস্তাব এসেছে। মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব এসেছে। লোকসভায় দাঁড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। প্রতিবারই ফিরিয়ে দিয়েছেন এই লড়াকু নেতা। এমন প্রলোভন ফেরাতে হিম্মৎ লাগে বইকি।

কিন্তু ভোটের ফল কী হল?‌ গোটা রাজ্যে যা হল, চাকুলিয়াতেও তাই হল। বামেরা তৃতীয়। হিন্দু–‌মুসলিম মেরুকরণের শিকার হতে হল তাঁকেও।

এদিকে ভোটের পর দলের মধ্যেও ডামাডোল। দলের একটা বড় অংশ পতাকার রঙ বদল করতে উঠেপড়ে লাগলেন। পতাকা থেকে লাল চিহ্ন সরিয়ে তাঁরা কাকে কী বার্তা দিতে চাইলেন, তাঁরাই জানেন। ভিক্টর চেয়েছিলেন দলের মধ্যে থেকেই লড়াই করতে। তাই তৈরি করেছিলেন আজাদ হিন্দ মঞ্চ। কিন্তু দলের নেতারা তড়িঘড়ি তাঁকে বহিষ্কার করে বসলেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটুকুও দিলেন না। যেটা আলাপ আলোচনায় মিটে যেত, সেটাকে সংঘাতের রাস্তায় নিয়ে গেলেন। এমন সম্পদকে অন্য দলে ঠেলে দিতে উঠেপড়ে লাগলেন।

ফলে, দলের মধ্যে থেকে লড়াই করার রাস্তাটা বন্ধ। বাধ্য হয়েই অন্য কোনও পথ বেছে নিতে হবে। এক অদ্ভুত বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে। যেখান থেকে অনেকগুলো রাস্তা দেখা যায়।

১)‌ অন্য দল গঠন করা। বামেদের সঙ্গেই শরিক হয়ে থেকে যাওয়া। কিন্তু একার চেষ্টায় একটা দল গড়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। কে রসদ জোগাবে?‌ একটা ব্লকে যদিওবা হয় অন্যান্য জেলায় তার বিস্তার ঘটানো খুবই কঠিন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটা ছোটখাটো শক্তিকে বামেরাই বা কতটা গুরুত্ব দিতেন?‌

২)‌ সিপিএমে যোগ দেওয়া। কথাটা শুনতে ভাল। কিন্তু বাস্তবে কঠিন। অন্য শরিক দলের বহিষ্কৃত নেতাকে দলে নিলে অন্যরকম জটিলতা তৈরি হবে। বামফ্রন্টের মধ্যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। সিপিএম নেতৃত্ব কি সেই ঝুঁকি নিতে তৈরি?‌ গঠনতন্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো?‌ তাছাড়া, তিনবারের বিধায়ককে প্রাথমিক সদস্যপদ দিয়ে ফেলে রাখাও মুশকিল। অন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে আসা এক নেতাকে জেলা কমিটিতেও হয়ত নেওয়া যাবে না। তাছাড়া, ভিক্টরের যা কাজ করার ধরন, তার সঙ্গে সিপিএমের কর্মপদ্ধতি খাপ খাবে না। সিপিএম যে শৃঙ্খলায় চলে বা যে কাঠামোয় চলে, ভিক্টরের পক্ষে সেই কাঠামো মেনে কাজ করা বেশ মুশকিল। তাই সিপিএমে যোগদানের সম্ভাবনাও প্রায় নেই বললেই চলে।

৩)‌ সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল তৃণমূলে যোগ দেওয়া। তাতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াইটা করতে হত না। সবকিছুই মসৃণভাবে চলত। এলাকার কারও কারও আপত্তি থাকত। কারও কারও মুখ ভার হত। কিন্তু তাতে কিছু আটকাতো না। স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি দলে নিলে কারও আপত্তিই ধোপে টিকত না। তিনিই হয়ত জেলার মুখ হয়ে উঠতে পারতেন। ডিএম, এসপি তাঁর কথা শুনেই চলতেন। সরকারি ক্ষমতার পুনর্বাসন?‌ সেটাও কিছু না কিছু রাস্তা বেরিয়ে যেত। আপাতত উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ, এনবিএসটিসি বা সংখ্যালঘু উন্নয়ন বা সরকারি কোনও সংস্থায় পুনর্বাসন হতে পারত। বা তাঁকে চেয়ারম্যান করার জন্যই হয়ত মুখ্যমন্ত্রী কোনও পর্ষদ গড়ে দিতেন। জেলা পরিষদে দাঁড় করিয়ে সভাধিপতি বা সহকারী সভাধিপতি করা যেত। সাংগঠনিক পুনর্বাসনও হয়ে যেত। আর এক বছর পর লোকসভায় রায়গঞ্জ আসন তো ছিলই। এমনিতেই রায়গঞ্জ তৃণমূলের হারা সিট। ফলে কোনও স্ট্যান্ডিং এমপিকে বসাতেও হত না। রায়গঞ্জ লোকসভার যা বিন্যাস, সংখ্যালঘু ভোটের পরিমাণ বেশ ভালই। মেরুকরণের আবহে তার সিংহভাগই এসে যেত তাঁর দিকেই। বাকি অঙ্কটুকু মেলাতে খুব একটা সমস্যা হত না। মোদ্দা কথা, তৃণমূলে গেলে অনেক পুনর্বাসনের সুযোগ। সরকারের সঙ্গে, পুলিশের সঙ্গে লড়াইও করতে হত না। লোক জমায়েত করতেও বেগ পেতে হত না। কারণ, সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি পুলিশ–‌প্রশাসনকেও কাজে লাগানো যেত। কিন্তু এতকিছুর পরেও তিনি কি তৃণমূলে যাবেন?‌ মনে তো হয় না। এতদিন তৃণমূলের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার হয়ে এসেছেন, সেই পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন?‌ তাঁর পক্ষে আর যাই হোক, চাটুকার হওয়া কঠিন। স্বাধীনচেতা এই নেতাকে হজম করা তৃণমূলের পক্ষে খুব সহজ হবে না। তাই অনেক সম্ভাবনার লোভনীয় প্রস্তাব থাকলেও এই দরজাটা বোধ হয় বন্ধই রাখবেন।

৪)‌ একটা সময় তাঁকে নিতে উঠেপড়ে লেগেছিল বিজেপি। মুকুল রায় থেকে দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী— সবাই তাঁকে দলে টানতে চেয়েছেন। কিন্তু এড়িয়ে গেছেন ভিক্টর। তিনি কখনই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেননি। স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে বারবার ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। একজন প্রগতিশীল মানুষের যে ভাষায় কথা বলা উচিত, সেই ভাষাতেই কথা বলেছেন। সংখ্যালঘু এলাকার সভায় গিয়েও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন। কজন পারেন এই ঝুঁকি নিতে?‌ এমনকী মৌলবিদেরও চটিয়েছেন। তাঁর পুরনো ভিডিওগুলো শুনলেই বোঝা যাবে। সেই ছেলের পক্ষে বিজেপিকে যাওয়া কার্যত অসম্ভব।

৫)‌ বাকি রইল আরও একটা পথ। কংগ্রেস। এখনও পর্যন্ত যা গতিপ্রকৃতি, তাতে সেই পাল্লাটাই ভারী। ভিক্টর বরাবরই স্বাধীনচেতা। নিজের কথা স্পষ্টভাবে বলতে ভালবাসেন। তাঁর পক্ষে কংগ্রেসটাই হতে পারে উপযুক্ত মঞ্চ। কানহাইয়া কুমারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা অনেকদিনের। কানহাইয়া তাঁকে অনেকবারই দলে টানতে চেয়েছেন। দীপা দাশমুন্সি থেকে অধীর চোধুরি, অনেকেই আন্তরিকভাবে চাইছেন, ভিক্টর তাঁদের সঙ্গে সামিল হোন। দুরন্ত হিন্দি বলেন। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাঁকে স্টার ক্যাম্পেনার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া, কংগ্রসে গেলে বামেদের সঙ্গে সখ্যতাও থাকবে। লোকসভা নির্বাচনে নিশ্চিতভাবেই বাম–‌কং জোট হবে। সেক্ষেত্রে রায়গঞ্জ আসন হয়ত কংগ্রেস দাবি করল। বামেরা পাল্টা দাবি নাও জানাতে পারে। বাম–‌কং জোটের প্রার্থী হয়ে লড়তেই পারেন ভিক্টর। তাঁর নামে বাম শিবিরে তেমন কোনও আপত্তি থাকবে বলে মনেও হয় না।

এই পাঁচটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হল। সবদিক বিচার করলে হয়ত শেষ সম্ভাবনাটাই বেশি উজ্জ্বল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.