‌ডিম নিয়ে ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন

অন্তরা চৌধুরি

আচ্ছা ডিম খেতে কে না ভালবাসে বলুন তো? এককথায় উত্তরটা হল সাত থেকে সাতানব্বই সকলেই ভালবাসে। কিন্তু বাঙালি সেকথা কিছুতেই স্বীকার করবে না। কারণ, ডিমের মধ্যে নাকি কোনও কৌলীন্য নেই। বংশমর্যাদা নেই। স্ট্যাটাস নেই। মুরগি হলে সে না হয় আওয়াজ করত, প্রতিবাদ জানাত। কিন্তু বেচারা ডিম! সে তার দুঃখের কথা কাকে আর বলবে!

প্রশ্ন হল, ডিম যখন সকলেই খেতে ভালবাসে, তখন আমাদের যে কোনও অনুষ্ঠানে সে ব্রাত্য কেন? দেখা গেল, মেয়ের বাবার প্রচুর টাকা। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কন্টিনেন্টাল ডিশের ব্যবস্থা করেছেন। চিকেন, মটন–সহ ভ্যারাইটি ফিশের ছড়াছড়ি। অথচ সেখানে একমাত্র ডিমেরই কোনও পদ নেই। ডিম নাকি অশুভ। তাই যদি হয়, তাহলে ফিশ বা চিকেন কবিরাজিতে ডিম দেওয়া হল কেন? যে কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে একটা সমীক্ষা করুন। মাছ, ডিম, মাংসের তিনটে স্টল দিয়ে দেখুন কোন স্টলে ভিড় বেশি। মানুষ এখন ওবেসিটির কারণে মটন খেতে চায় না। ডাক্তারের কড়া হুকুম, ‘রেড মিট নৈব নৈব চ’। কিন্তু শুভ অনুষ্ঠানে মাটন না খাওয়ালে গৃহকর্তার প্রেস্টিজ ডাউন। লোকে বলবে ‘কিপ্পুস’। আগে চিকেনও ব্রাত্য ছিল। এখন সে অল্প একটু প্রবেশাধিকার পেয়েছে। কিন্তু এই মহাযজ্ঞে ডিমের কোনও স্থান নেই।

আচ্ছা ডিম যদি এতটাই স্ট্যাটাসহীন হয় তাহলে শহুরে বুদ্ধিজীবিদের ব্রেকফাস্ট টেবিল ডিম ছাড়া অসম্পূর্ণ কেন? দুটো কুড়কুড়ে টোস্ট, একটা কলা আর সঙ্গে ডিমের পোচ বা স্ক্র্যাম্বেল এগ ছাড়া তো শহুরে ব্যস্ত মানুষের মুখে ব্রেকফাস্ট রোচে না। সেই খেয়ে তেনারা নির্বিঘ্নে দিনের পর দিন স্কুল, কলেজ, অফিস, কাছারি করে যাচ্ছেন। তাহলে ডিম অশুভ হয় কোন যুক্তিতে! ঘটা করে জন্মদিনে কেক না কাটলেই নয়। সেই শুভ অনুষ্ঠানের কেক কিন্তু ডিম দিয়েই বানানো।

আবার ধরুণ কোনও আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে খেতে গেছেন। সেখানেও মেনুতে সেই মাছ বা মাংসের আস্ফালন। আপনি খুব ভালভাবে জানেন, যাঁদের বাড়িতে খেতে গেছেন, তাঁদের টাকার অভাব নেই। তা এই বাজারে ইলিশ, মাটনের পাশাপাশি ডিমেরও কি দু একটা পদ রাখা যেত না? মানুষ একটু তৃপ্তি করে খাবে, খুশি হবে। কিন্তু না। সেটি হবার জো নেই। আসলে ডিমের দাম কম বলে সে কোনওদিন লাইমলাইটে আসতেই পারল না। চিরকাল উপেক্ষার পাত্র হয়েই থেকে গেল।

আসলে, অতিথিকে ডিম খাওয়ালে কোথায় যেন একটু আত্মসম্মানে লাগে। উচ্চবিত্তের তকমায় ভাঁটার টান পড়ে। রেস্টুরেন্টে খেতে যান। সেখানেও এগ ফ্রায়েড রাইস, এগ নুডলস্ থাকলেও ডিমের আলাদা কোনও পদ নেই। একবার ভেবে দেখুন তো বাড়িতে যেদিন ডিমের ঝোল রান্না হয় সেদিন পাতে কিন্তু একটা ডিমই দেওয়া হয়। অথচ আড়াইশো টাকা কেজি মাছ বা ছ‘শো টাকা কেজি মাংস বেশ কয়েক পিস দেওয়া হয়। পরে চাইলে আবার দেওয়া হয়। কিন্তু পাঁচটাকার ডিম কিছুতেই দুটো দেবে না। বাড়ির গিন্নি জানতে চান, ‘আরেকটু মাংস দিই?’, ’ আরেকটা মাছ দিই?’ কিন্তু কখনও বলতে শুনেছেন, ‘আরেকটা ডিম দিই!’ মাছ, মাংস দেওয়ার বেলায় এত উদার। ডিমের বেলায় এত কিপ্টেমি কেন? একমাত্র রক্তদান শিবিরেই ডিম বাবুর কিছুটা গুরুত্ব আছে। এক ইউনিট রক্ত দিলে, স্যান্ডউইচ বা ফ্রুট জুসের সঙ্গে প্যাকেটে একটা ডিম থাকে।

বাড়িতে গেস্ট এলে চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে তাকে আমরা প্লেট ভর্তি মিষ্টি দিয়েই আপ্যায়ণ করি। এখন সকলেই ফিগার কনশাস্। অধিকাংশ মানুষই মধুমেয় নামক বস্তুটির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। তাই যত দামি মিষ্টিই দিন, মিষ্টি দেখেই অধিকাংশ অতিথি মুখ বেঁকিয়ে নিজের মিষ্টি না খাওয়ার একশো কুড়িরকম ফিরিস্তি দিতে শুরু করে। তাই এবার থেকে মিষ্টি না দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের মতো একখানা ডবল ডিমের অমলেট দিয়ে ট্রাই করুন। অথবা দুটো ডিম সেদ্ধ দিন। দেখুন অতিথির মুখে জ্যোৎস্না মাখানো কী মধুর হাসি ঝরে ঝরে পড়বে। মাত্র দশ টাকা খরচ করে যদি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যায়, মন্দ কী! শুধু আমাদের চিন্তাভাবনাটা একটু বদলানো দরকার।

গত কয়েক বছরে মফঃস্বল এবং কলকাতা মিলিয়ে মিষ্টির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। একদিকে সাইজ ছোট হচ্ছে, অন্যদিকে দাম চড়চড় করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাসি মিষ্টি গছানোর ঝক্কি তো আছেই। মিষ্টি খেতে যেমনই হোক তার গেটআপ ঝকঝকে করে এক একটা মিষ্টির দাম হয়েছে কুড়ি টাকা, পঁচিশ টাকা। তার নীচে কোনও মিষ্টি নেই। কারও বাড়িতে এখন আর একশো টাকার মিষ্টি নিয়ে যাওয়া যায় না। প্যাকেটের সাইজ আর মিষ্টির সংখ্যা দেখলে আপনি নিজেই লজ্জা পাবেন। আপনার পকেট পারমিট না করলেও নেহাত ভদ্রতার খাতিরে হয়ত আপনি পাঁচশ টাকার মিষ্টি নিয়ে গেলেন; অমনি আপনাকে শুনতে হবে, ‘এসবের কী দরকার ছিল? আমরা তো কেউ মিষ্টি খাই না।’ এসব ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনে কীরকম গায়ে জ্বালা ধরে বলুন তো! তাই পরের বার চুপচাপ স্রেফ ষাট টাকা খরচ করে এক ডজন ডিম নিয়ে যাবেন। কে কী ভাবল সেটা ভাবার দায় আপনায় নয়। শুধু এই কারণেই মানুষ আপনাকে চিরদিন মনে রেখে দিতে পারে।

এই যে ধরুন আমাদের সমাজ দিনের পর দিন ডিমের সঙ্গে এইভাবে বঞ্চনা করছে; ডিম কি সেই সমাজকে কোনওদিন ক্ষমা করবে? ডিম হচ্ছে গাছের মতো সহনশীল। এই যে করোনা পর্বে, মানব জাতি যেখানে ধংসের মুখে দাঁড়িয়ে, সেখানে ডিমই কিন্তু পরিত্রাতা। লকডাউনের সময় মানুষ যখন মৃত্যু ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল; মাছ বা মাংস কিনতে গিয়েও দশবার ভাবছিল কেনা উচিত হবে কি না, সেই দুঃসময়ে একমাত্র ডিমই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, ভাইরোলজিস্টরা বলেছিলেন, গরম জিনিসের মধ্যে করোনা থাকতে পারে না। তাই কাটা মাছ বা মাংস অপেক্ষা ডিম অনেক বেশি সেফ। মাছের ট্রাক আসছিল না। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা মাছ আর মাংসের দাম হু হু করে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একদল শোষণ করেছে আর একদল শোষিত হয়েছে। কিন্তু সেই কঠিন দুঃসময়ে নিজেকে সংযত রেখেছিল একমাত্র ডিম। চাহিদার গোলকধাঁধায় পড়ে ডিমের চোখ ঝলসে যায়নি। তাই রোজ সকালে দেখতাম সব মানুষের হাতেই পেটি পেটি দিম। কিন্তু মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ। অসময়ের বন্ধুকে কেউ মনে রাখে না। কেউ মনে রাখেনি। যে নিজের জীবনের বিনিময়ে অম্লান বদনে দিনের পর দিন অগ্নিতে নিজের পরীক্ষা দিয়ে মানুষের রসনা তৃপ্তি করছে, তাকে মানুষ উপেক্ষাই করে গেল।

অথচ সেও তো আরও পাঁচজনের মত নতুন জীবন পেতে পারত। এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ অনুভব করতে পারত। বাঁচার অধিকার তো তারও আছে। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি আমাদের রসনা তৃপ্ত করাতেই যেন ডিমের জীবনের একমাত্র সার্থকতা। অথচ আমরা যখন অম্লান বদনে ডিম খাই, তখন কি একবারও ভাবি কত মুরগির কোল খালি হয়ে গেল। প্লেটের ওপর সাজানো ডিমটাই হয়তো একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা হতে পারত। মায়ের সঙ্গে ঘুরঘুর করতে পারত। ভোরবেলায় ‘কোঁকর কোঁক’ করে অন্যদের ঘুম ভাঙাতে পারত। ডিমের এই নিঃসার্থ আত্মত্যাগের ইতিহাস কি মানব জাতি মনে রাখবে? নাকি ‘ডিম রবে চিরকাল হতাশের নিস্ফলের দলে?’

সময় এসেছে। এবার অন্তত ডিমকে নিয়ে একটু ভাবুন। অন্ততপক্ষে ভাবা প্র্যাকটিস করুন।‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.