স্বরূপ গোস্বামী
ডুয়ার্স বললেই এক মুহূর্তে ভেসে ওঠে জঙ্গল। কারও কারও আবার হাতি, হরিণ, গন্ডার, বাইসনের কথাও মনে পড়ে। আসলে, এটাই ডুয়ার্সের চেনা ছবি। এমনকী সবজান্তা গুগলের দ্বারস্থ হলে সেও জঙ্গল, রেলললাই, হাতি, বনবাংলো–এসব ছবিই ঘুরে ফিরে হাজির করবে।
কিন্তু আমাদের চোখে সেবার ধরা দিল অন্য এক ডুয়ার্স। চেনা ডুয়ার্সের থেকে একেবারেই অন্যরকম। বেশ কয়েক বছর ধরেই ডুয়ার্সে আসা যাওয়া। সঙ্গী বদলের সঙ্গে ঠিকানাও বদলে যায়। গত বছর যাই যাই শীতের সময় পাড়ি দিয়েছিলাম রাজাভাতখাওয়া। ঘন জঙ্গল বা জন্তু জানোয়ার, কোনওটাই নেই। কিন্তু কেন জানি না, এই নির্জন জায়গাটা বেশ ভাল লাগে। নির্জন এক স্টেশন আছে। পরিমলদার দোকান আছে। লিও কটেজ আছে। একটু গেলেই সাধুবাবার মন্দির আছে। নাম না জানা ঝোরা আছে। নির্জন রাস্তায়, নরম রোদ গায়ে মেখে, হাতে হাত রেখে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চ আছে।
আগের দিন এখান থেকেই বক্সা অভিযান হয়ে গেছে। দুর্গম সেই পাহাড়ে ওঠার পর নিজেদের যেন তেনজিংয়ের খুড়তুতো ভাই মনে হচ্ছিল। ফিরে আসার পর মনে হল, কালকের দিনটা অলসভাবেই কাটানো যাক। কিন্তু সকালে হাঁটতে বেরিয়ে মনে হল, পুরো দিনটা এভাবেই কাটাবো? আশেপাশে কোথাও একটা গেলে কেমন হয়! মুশকিল আসান সেই বাবু। ভাল নামটা কী, জানা হয়নি। জানার দরকারও নেই। বাবু নামেই গোটা রাজাভাতখাওয়ায় পরিচিত। ছোটখাটো একটি ছেলে। অটো নিয়ে সারাদিন এদিক–সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সকালে হাঁটতে হাঁটতে চেকপোস্টের কাছে দেখা হয়ে গেল বাবুর সঙ্গে। জানতে চাইল, আজ কোথাও যাবে না। কী মনে হল, জানি না। হঠাৎ ওকে বলে বসলাম, চলো, তুমি যেদিকে নিয়ে যাবে, সেদিকেই যাব। তবে দূরে কোথাও নয়। মোটামুটি আধঘণ্টার মধ্যে। দুপুরের মধ্যে যেন ফিরে আসতে পারি।
বাবু বলল, আগে কখনও সিকিয়াঝোরা গেছ? বললাম, নাম শুনেছি, তবে যাওয়া হয়নি। কারণ, তুমি তো নিয়ে যাওনি।
গিন্নির মুখের দিকে আঁড়চোখে তাকালাম। বুঝলাম, তাঁরও তেমন আপত্তি নেই। সে জানতে চাইল, সেখানে কী আছে?
একটু সবজান্তা না সাজলে প্রেস্টিজ থাকে না। তাই যে দু–চার লাইন জানি, উগরে দিলাম। বললাম, এটাকে অনেকটা সুন্দরবনের মতো। কেউ কেউ একে উত্তরের অ্যামাজনও বলে থাকে। বাকিটা এখন বলছি না, তাহলে যাওয়ার আকর্ষণ থাকবে না।
গিন্নি ভাবল, আমি বোধ হয় সিকিয়াঝোরা সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানি। মোটেই না। আমার বিদ্যেবুদ্ধি ওই দু লাইনেই সীমাবদ্ধ। সেটা আমি নিজে সবথেকে ভাল বুঝি। তাই ঠিক জায়গায় থেমে গেলাম।
কোন পথ দিয়ে যেতে হয়, কতক্ষণ লাগে, কিছুই জানি না। জানার দরকারও নেই। বাবু আছে তো। স্টিয়ারিং যখন তার হাতে, সে জানলেই চলবে। কোন পথ দিয়ে নিয়ে গেল, বলা মুশকিল। তবে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ সুন্দর। চা বাগান আছে। জঙ্গলও আছে। মোটামুটি আধঘণ্টার মধ্যেই হাজির হয়ে গেলাম সেই সিকিয়াঝোরায়।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, নিতান্ত সাধারণ একটা পার্ক। একটু দূরে একটা ছোট জলাশয়। হাতে টানা দুটো নৌকো দাঁড়িয়ে আছে। এমন বোটিং তো পাড়ায় পাড়ায় আছে। একে কিনা উত্তরের অ্যামাজন বলে! যদি গিন্নির ভাল না লাগে, তাহলে আমার কপালে কী কী বিশেষণ জুটবে, সেটাই ভাবছি। নির্ঘাত বলবে, এই পানাপুকুরে বোটিং করানোর জন্য এতদূর নিয়ে এলে! ভোজের শেষপাতে (মানে, রোমাঞ্চকর ডুয়ার্স ভ্রমণের বিদায়বেলায়) যদি ভুলভাল জিনিস জুটে যায়, তাহলে পুরো আনন্দটাই মাটি। টিকিট কেটে উঠে পড়লাম নৌকোয়। সকাল দশটা। আমরাই প্রথম যাত্রী। স্বাভাবিকভাবেই দুই মাঝি পুজো টুজো করে রওনা দিল। নৌকোয় দেখলাম টুকটাক নানা রকম অস্ত্র। এগুলো দিয়ে কী হবে? একজন জানাল, অনেক জন্তু জানোয়ার থাকতে পারে। কোনটা কখন কাজে লাগে!
এই এঁদো পুকুরে জন্তু জানোয়ার! নৌকো একটু একটু করে এগোতে লাগল। প্রথমে বাঁশ দিয়ে ঠেলা। তারপর আর মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। তখন দাঁড় বাওয়া। দূর থেকে যেটা পুকুর মনে হচ্ছিল, একটু এগোতেই সে যেন নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছে। বাঁদিকে বাঁক নিয়ে সে ঢুকে গেছে জঙ্গলে। দুপাশের জঙ্গল ক্রমশ ঘন হতে শুরু করেছে। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে এই ঝোরা। এই নদী কতদূর গেছে? মাঝিভাই জানাল, অনেকদূর। আপাতত আমরা দু কিলোমিটার যাব। তারপর আর যাওয়ার নিয়ম নেই। সে কী! দু কিলোমিটার! এই জঙ্গলের মধ্যে! বিস্ময়ের তখনও অনেক বাকি।
যাক, এবার অন্তত এঁদো পুকুরের জন্য তিরষ্কার জুটবে না। বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে। অ্যামাজন বলে খুব একটা ভুল করিনি তাহলে! মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছি।
একটু এগোতেই দুপাশের নানা জায়গায় বড় বড় পায়ের ছাপ। বুঝতে অসুবিধে হল না, ছাপগুলো হাতির। বারবার ডুয়ার্স আসার সুবাদে হাতির পটি কেমন, সেটাও দিব্যি চিনে গেছি। সেই নমুনাও এখান ওখানে ছড়িয়ে আছে। পায়ের ছাপগুলো দেখে মনে হল, বেশ টাটকা। অর্থাৎ, সকালেই এখান থেকে জল খেয়ে গেছে। এই অনুমানের কথাই জানালাম দুই মাঝিভাইকে। তারাও ঘাড় নেড়ে জানাল, একটু আগেই জল খেয়ে গেছে। আশেপাশেই কোথাও আছে।
আর কী কী আছে? হরিণ, চিতাবাঘ, অজগর… তালিকাটা বেশ লম্বা হতে লাগল। এটুকু বুঝি, এই মাঝিভাইরা ট্যুর অপারেটরদের মতো বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে না। যা তারা রোজ দেখে, তাই বলছে।
নৌকো চলতে চলতেই একের পর এক রোমাঞ্চকর গল্প শুনছিলাম তাদের কাছে। বেশ ভালই লাগছিল। বোঝা গেল, চিতাবাঘ–হাতি, অজগর এদের কাছে জলভাত। আমরা যেমন রাস্তায় কুকুর দেখি, অনেকটা সেইরকম। সেসব নিয়ে খুব একটা ভয়–ডর আছে বলে মনেও হল না। একজন বলে ফেলল, ওরাও মানুষ চেনে। আমাদের দিকে আসবে না। হাতি এলে কীভাবে পালাতে হয়, সেটা ছোট থেকেই শিখেছি। চিতাবাঘও নিজে থেকে কিছু করবে না। ওর বাচ্চার দিকে হাত বাড়ালে তবেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরকম নানা টোটকা দিয়ে চলেছিল। কিন্তু নিশ্চিত জানি, এই টোটকা গুলো আমাদের কোনও কাজে লাগবে না। কারণ, হাতি বা চিতাবাঘ সামনে এসে গেলে কোনও বুদ্ধিই তখন কাজ করবে না। নিজের নামটাও তখন আর মনে থাকবে না।
দুপাশে নাম না জানা গাছের মিছিল। সেখানে কত অজানা পাখি। আপন মনে ডেকে চলেছে। কোনটা কার আওয়াজ, তা নিয়ে তর্ক করা বৃথা। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! ওই পরিযায়ীদের কোনও পাসপোর্ট, ভিসা লাগে না। তারা উড়তে উড়তে ঠিক চলে আসে। আবার শীত ফুরোলে আপন দেশে চলে যায়। ‘বলো কোথায় তোমার দেশ’ বলে গান গাইলেও কিছুই বুঝবে না। বা বুঝলেও, ওর উত্তর আমরা বুঝব না।
এভাবেই কতদূর চলে এলাম, খেয়াল নেই। ঝোরার মাঝে বেশ বড় বড় ডাল পড়ে আছে। মানে, পর্যটকদের জন্য ওটাই সীমানা। কিছুটা বেয়াড়া আবদার করে বলে ফেললাম, এর ওপারে যাওয়া যায় না! এখানে তো আর সিসিটিভি নেই। একটু গেলেই বা কে বুঝছে? দুই মাঝিভাই আমাদের ইঙ্গিতটা বুঝল। তারপর বলল, আরও কিছুটা যাওয়া যায়। যদি যেতে চান।
গিন্নির মধ্যে তখন দারুণ এক রোমাঞ্চ। সে বলল, হ্যাঁ কাকু, চলো। এতদূর যখন এলাম, আরও কিছুদূর যাওয়াই যায়। এত কাছ থেকে জঙ্গল তো কখনও দেখিনি। জিপ সাফারি করেছি। কিন্তু এটা একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
নৌকো চলল আরও গভীরে। শীতের সময়। তাই তেমন অজগরের দেখা নেই। অন্যসময় এই যাত্রাপথে নির্দিষ্ট কয়েকটা জায়গায় নাকি অজগর উকি দেয়। আরও বেশ কয়েকটা জায়গায় হাতির পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। দু একটা চিতাবাঘের পায়ের ছাপও দেখাল মাঝিভাইরা। বোঝা গেল, মাঝে মাঝেই তারা চরণচিহ্ন এঁকে দিয়ে যায়।
এবার ফেরার পালা। নিজেদের মধ্যে বেশি কথা বলতেও যেন অপরাধ বোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে, আমরা বোধ হয় জঙ্গলের নির্জনতা ভঙ্গ করছি। এমন নির্জন জঙ্গল তো সত্যিই আগে দেখিনি। কত অজানা পাখির কলতান! মুগ্ধ হয়ে জঙ্গল দেখব নাকি ছবি তুলব! সঙ্গে দামী ক্যামেরা নেই। মোবাইলই ভরসা। তাতে কতটুকুই বা ধরা যায়! ক্যামেরা থাকলেই বা কতটুকু ধরা যেত! কোনও ক্যামেরার সাধ্যি নেই এই গা ছমছমে রোমাঞ্চ এনে দেবে। সেই রোমাঞ্চ একান্তই অনুভবের।
এতবার ডুয়ার্সে এসেছি। কিন্তু এমন একটা জায়গায় কেন আসিনি! নিজেদের ওপরই রাগ হল। নৌকোয় বাবুও সঙ্গে ছিল। ভাগ্যিস বাবু সিকিয়াঝোরার প্রস্তাবটা দিল! নইলে তো এবারও আসা হত না। অন্তত আমাদের পরিকল্পনার মাঝে কোথাও ছিল না এই উত্তরের অ্যামাজন। বাবুকে কী ভাষায় ধন্যবাদ জানাব! শব্দভান্ডারের কোনও শব্দই জুৎসই মনে হল না। আমাদের রোমাঞ্চ, আমাদের মুগ্ধতা দেখে যা বোঝার, ও বুঝে নিক।
*******
কীভাবে যাবেন?
কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস বা পদাতিক এক্সপ্রেসে আলিপুরদুয়ার। সেখান থেকে যে কোনও অটো চালককে বললে সে ঠিক নিয়ে যাবে। মোটামুটি ৪০–৪৫ মিনিটের পথ।
কোথায় থাকবেন?
সিকিয়াঝোরায় থাকার তেমন জায়গা নেই। তবে কিছু কটেজ তৈরি হচ্ছে। তবে আলিপুরদুয়ার বা রাজাভাতখাওয়া থেকেও অটো নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন।