স্বরূপ গোস্বামী
এখানে গেস্ট হাউস? কে থাকতে আসবে এই জঙ্গলে? কেনই বা আসবে?
ছেলের দিকে ঠিক এই প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন প্রবীণ মাস্টারমশাই।
ছেলেও নাছোড়। এখানে তিনি গেস্ট হাউস বানিয়েই ছাড়বেন। ঠিকঠাক প্রোমোট করতে পারলে ট্যুরিস্ট ঠিক আসবে।
বাবা–ছেলের এই কথোপকথনটা মোটামুটি বছর পনেরো আগের। পনেরো বছর পরের ছবিটা অবশ্য বাবা–ছেলে দুজনের পক্ষেই বেশ স্বস্তিদায়ক। হ্যাঁ, সত্যিই এখানে ট্যুরিস্ট আসছেন। সেই চাহিদা এতটাই যে অনেক পর্যটককে নিরাশ হতে হচ্ছে।
আসলে, এই তাকদা শহরের সঙ্গে একটা ইতিহাস জড়িয়ে আছে। একদিকে পাইনের বন থেকে ভেসে আসছে মেঘের সারি। অন্যদিকে, সেই ইতিহাসের হাতছানি। সবমিলিয়ে জায়গাগা বেশ রোমাঞ্চকর।
পাহাড়ের নানা জায়গায় পায়ের ছাপ পড়েছে ইংরেজদের। তাঁরা যত্ন করে সাজিয়েছেন বিভিন্ন জনপদকে। ওই দুর্গম এলাকায় রেললাইন পাতা, রাস্তা তৈরি করা, স্কুল–কলেজ তৈরি করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। বরং স্বাধীনতার পর আমরা নিজেদের চেষ্টায় কতটুকু এগোতে পেরেছি, সেই প্রশ্নটাই যেন বড় হয়ে ওঠে।
তাকদায় এলে ব্রিটিশ স্থাপত্য যেন আরও বেশি করে মন কেড়ে নেয়। এখানে সেনাবাহিনীর আলাদা ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা। মোটামুটি ১৯০৫ থেকে ১৯১১ এই সময়ের মধ্যে তৈরি হয় একের পর এক কীর্তি। তৈরি হয় সতেরোটি হেরিটেজ বাংলো। কোনওটি এখন বিলুপ্ত। কোনওটার ভগ্নদশা। কোনওটি হয়েছে স্কুল, কোনওটি গেস্ট হাউস। এভাবেই ইতিহাসের গন্ধ গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে এইসব স্থাপত্য।
ইচ্ছে ছিল, কোনও একটা হেরিটেজ বাংলোয় থাকার। সেখানকার ইতিহাসটাকে একটু ছুঁয়ে দেখার। সেই তাগিদ থেকেই তাকদায় যাওয়ার ইচ্ছে। ইউটিউবের সৌজন্যে বেশ কয়েকটা বাংলোর হদিশ পাওয়া গেল। কোনওটার আকাশছোঁয়া ভাড়া। কোনওটায় আবার বুকিং নেই। সবমিলিয়ে জায়গা হল সাইনো গেস্ট হাউসেই। ইউটিউবের ভিডিও দেখে প্রাথমিক একটা ভাল লাগা তৈরি হয়েছিল। বাকিটা তো গিয়েই বুঝতে হবে।
তাকদা যাওয়ার রাস্তাটা বেশ উপভোগ্য। দুধারে পাইন গাছের সারি। মেঘ ভেসে আসছে। দিনের বেলাতেও কেমন একটা গা ছমছমে অনুভূতি। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চই আলাদা। দার্জিলিং থেকেও আসা যায়। আবার কালিম্পং থেকেও আসা যায়। দুদিক থেকেই মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েকের পথ। সব বাংলোগুলোই রাস্তা থেকে অনেকটা উপরে। সাইনোও তাই। সামনে লন। বিরাট বারান্দা। ফায়ারপ্লেসের চিমনি, দরজা–জানালাই জানান দিয়ে যাচ্ছে, বাংলোটা কত পুরনো। লনেই দুদিকে রয়েছে ফোয়ারা। আধুনিক অঙ্গশয্যা নয়, ইতিহাসেরই গন্ধ মাখা। কিন্তু আমাদের বিধি বাম। যাওয়ার পর থেকেই ঝিরঝির বৃষ্টি। ফলে, বাইরে বেরোনোর তেমন উপায় নেই। অবশ্য শুধু বৃষ্টি উপভোগ করতে হলেও তাকদার এই বাংলো আদর্শ। আপনমনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখুন, বই পড়ুন, গান শুনুন বা গুনগুন করে গেয়ে উঠুন। আলস্য যাপনের এমন সুযোগ খুব বেশি আসে না। পাহাড় মানেই তো শুধু চড়াই উতরাই নয়। এমন বাংলো তো আলস্যকেই আমন্ত্রণ জানায়।
নিচের চারটে ঘর পর্যটকদের জন্য। ওদিকের দুটো ঘর কিচেন আর ডাইনিংয়ের কাজে ব্যবহার হয়। ওপর তলায় থাকেন প্রবীণ দম্পতি। দুই কেয়ারটেকার নিরন আর রোশন। নিরনের বাড়ি মালবাজারে। বেশ লাজুক। রোশনের গানের গলাটা চমৎকার। গলায় ক্লাসিকাল টাচ। কঠিন কঠিন গানগুলোকেও কী নিখুঁত সুরে গাইছে। আমাদের ঠিক পাশের ঘরেই ছিল এক নবীন দম্পতি। দেবমাল্য আর দেবাঞ্জলি। দুজনেই কৃতী ইঞ্জিনিয়ার। বেশ প্রাণবন্ত জুটি। দাম্পত্য আর নিবিঢ় বন্ধুত্ব যেন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। সন্ধে থেকে তাঁদের সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প করে দিব্যি কেটে গেল।
বেড়ানোর সঙ্গে খাওয়ার একটা অনুষঙ্গ না থাকলে তা পূর্ণতা পায় না। পাহাড়ে গিয়ে ক্যালোরির হিসেব চুলোয় যাক। নিরন বা রোশনের হাতের সেই সুন্দর রান্নাকে অসম্মান করার কোনও স্পর্ধা নেই। দুপুরে বাঙালি আদলে, রাতে কিছুটা চৈনিক সংস্কৃতি। সবমিলিয়ে বেশ উপভোগ্য। ইচ্ছে ছিল, ভোরের দিকে যদি কোথাও বেরোনো যায়। নিদেনপক্ষে উপরের গুম্পায়। কিন্তু কোনওটাই হল না। কারণ, ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। মেঘ একটু একটু করে সরেছে। দূরের পাহাড়গুলো একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। ওই তো, ওই দিকটায় তিনচুলে। ওই যে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে রংলি রংলিয়ট চা–বাগান।
কিন্তু এই বাংলোর ইতিহাসটাই তো জানা গেল না। কে বলতে পারেন? ফোনে যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল, সেই আনন্দজি থাকেন কার্শিয়াংয়ে। বেচারা নিরন বা রোশনের পক্ষে এত ইতিহাস জানা সম্ভব নয়। একমাত্র উপায়, আনন্দজির বাবা। প্রবীণ ওই মানুষটিকে বেশ কয়েকবার দেখেছি। বেশ সাহেবি চেহারা। দূর থেকে দেখেই বেশ সমীহ জাগছে। এই বয়সেও বেশ সক্রিয়। বেশ কয়েকবার নিচে নামলেন। এদিক–ওদিক হেঁটে বেড়ালেন। ইচ্ছে হল, তাঁর কাছেই দু–চার কথা শুনি। কিন্তু তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন। বললেন, একটু পরে আসছি।
একটু পরে এলেন। কথা বলে গেলেন মূলত হিন্দি আর ইংরাজিতে। তবে বাঙালি নামগুলো উচ্চারণ করলেন একেবারে নির্ভুল বাংলা উচ্চারণে। তাঁর কাছে যা যা জানলাম, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এখানে শুধু তার নির্যাসটুকুই লেখা যায়। তাঁর বয়ানেই বাকিটা শোনা যাক। ১৯০৫ নাগাদ এখানে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হয়। এরকম ১৭টি বাংলো বানানো হয়েছিল। তখন ছিল মাটির রাস্তা। গাড়ির তেমন চল ছিল না। তাই গাড়ি ওঠার আলাদা রাস্তা তৈরি হয়নি। এই ক্যান্টনমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। তারপর অবশ্য আলাদা করে এই ক্যান্টনমেন্টকে তেমন সক্রিয় করা হয়নি। ইংরেজটা ঠিক করলেন এই বাংলোগুলো নিলাম করবেন। কিন্তু এই পাহাড়ে কেই বা সেই বাংলো কিনবেন? তাই নিলাম হয়েছিল কলকাতায়। কলকাতার বড় বড় ব্যবসায়ী, উকিল, ডাক্তার, জমিদাররাই সেইসব বাংলো কিনলেন। বেশিরভাগ বাংলোর মালিক হয়ে গেলেন কলকাতার দিকপালরা।
প্রথম প্রথম তাঁরা ছুটি কাটাতে আসতেন। কিন্তু তারপর যা হয়! আসা–যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এই সাইনো বাংলোর আগের নাম ছিল চন্দ্রা ভিলা। যিনি কিনেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল চন্দ্রাবতী দেবী। স্ত্রীর নামেই বাংলোর নামকরণ। সেখান থেকে হাতবদল হল। কিনলেন যাদবপুরের এক মহিলা। কিন্তু তিনিও তেমন আসতেন না। আমি তখন এখানে হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতাম। আমি একদিন তাঁকে বললাম, আপনারা তো তেমন আসেন না। বাংলোটা এভাবেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে। উনি বললেন, আপনি কিনে নিন। আমার তেমন সামর্থ্য কই? তার মধ্যেও যতটা সম্ভব জোগাড় করে এই বাংলোটা কিনে নিলাম। কিছুটা মেরামত করে এখানেই থাকা শুরু করলাম। কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাংলোর স্থাপত্যকে, সাবেকিয়ানাকে ধরে রাখতে চেয়েছি।
কিন্তু সেই পরিত্যক্ত বাড়ি কীভাবে হয়ে উঠল এই সাইনো গেস্ট হাউস? প্রবীণ তাসি মোক্তান জানালেন, ‘এটা আদৌ গেস্ট হাউস হবে কিনা, আমার মনেই সংশয় ছিল। আমি ছেলেকে বলেছিলাম, এখানে কেউ থাকতে আসবে না।’ কিন্তু ও বলল, এই বাংলোর একটা ইতিহাস আছে। ভিউটাও দারুণ। ঠিকভাবে প্রোমোট করতে পারলে অনেকেই এখানে আসবে। যা করার, আমার ছেলেই করেছে। পুরো কৃতিত্বই ওর। আমাদের বয়স হয়েছে। আমরা এসব ব্যাপারে খুব একটা জড়াই না। তবে এই বাংলোর প্রচারের ব্যাপারে একজন বাঙালির কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। তিনি হলেন ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদক অমরেন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি একবার এসে পনেরোদিন এই বাংলোয় ছিলেন। তিনি এই বাংলো নিয়ে লিখলেন, আরও অনেককে এখানে আসার পরামর্শ দিলেন। তারপর থেকে লোক আসা–যাওয়া বাড়তেই লাগল।
সাতাশি বছরের প্রবীণ মাস্টারমশাইয়ের গল্প বলার ধরনটা বেশ আকর্ষণীয়। কীভাবে এই বাংলোর সাবেকিয়ানাকে তিনি ধরে রেখেছেন, সেটা শুনলে সত্যিই কুর্নিশ করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমাদের বুকিং তো মাত্র একদিনের। তাকদাকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হবে অন্য ঠিকানায়। সবকিছু গোছগাছ করে যখন নামছি, ইচ্ছে হল ওই প্রবীণ মানুষটির সঙ্গে একবার দেখা করে যাওয়ার। যদি আর কখনও দেখা না হয়! আমাদের অবাক করে উনি চিৎকার করে পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলায় বললেন, ‘আশা করছি, আবার দেখা হবে।’
হ্যাঁ, তাকদার প্রতি এই ভালবাসা একদিনে ফুরোনোর নয়। তাই মেঘ মাখা এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে আবার আসতেই হবে। এই তাকদার পরতে পরতে আরও কত অজানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। প্রবীণ ওই মাস্টারমশাইয়ের কাছে আরও কত গল্প শোনার আছে। আপাতত, গুডবাই তাকদা।