কুমকুম বসু দাস
বেড়ানো বলতে নির্দিষ্ট কোনও ট্যুরিষ্ট স্পটের কথা বলছি না। এ একেবারেই অন্যরকম ভ্রমণ আর সেই সুবাদে বাঘমামার দর্শনলাভ।
আমার স্বামী ছিলেন ভূতাত্ত্বিক। ভ্রাম্যমাণ কর্মজীবনে তাঁকে থাকতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রদেশের গভীর অরণ্য, দুর্গম পাহাড় আর উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে। সেই সুবাদে আমারও এইসব জায়গায় থাকার ও ঘোরার সুযোগ হয়েছে। তাই আমার লেখনীতে এরা ধরা দিয়েছে বারবার।
কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তখন তাঁর পোষ্টিং ছিল হায়দরাবাদে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ইষ্ট কোষ্ট বক্সাইট প্রজেক্টের জন্য পূর্বঘাট পর্বত মালার প্রত্যন্ত গ্রাম চিন্তাপল্লীর বেস ক্যাম্পে যেতে হবে ক্যাম্প ইনচার্জ হয়ে। লঙ জিপ জার্নি। ভোরবেলা হায়দরাবাদ থেকে রওনা হলাম। ভাইজ্যাক হয়ে সিকাকুলমের পথ ধরে এগোতে থাকলাম পূর্বঘাট পর্বতমালার অরণ্যপথে।
পাহাড়ের বুক চেরা আঁকা বাঁকা (হেয়ারপিন বেন্ট), মায়াবী পথ ধরে এগিয়ে চলেছে জিপ। জঙ্গলের নিজস্ব এক অদ্ভুত মাতাল করা সোঁদা গন্ধ আসছে। সূর্যের আলো এ পথে আসতে পারে না সরাসরি। গাছের ফাঁক দিয়ে ঝিলমিল কাটে; আলো আঁধারীর একটা অদ্ভুত লুকোচুরি চলে। পথের ধারে বানরের দল কিচমিচ করে। অরণ্যের নির্বাক নৈশব্দের মধ্যে ছোটছোট ঝর্ণার কলধ্বনি। মাঝে মাঝে কোনও গ্রামবাসী কাঠের বোঝা বা জলপূর্ণ কলস নিয়ে স্বছন্দে উঠে যাচ্ছে। প্রাণভরে অনুভব করছি এই সৌন্দর্য।
হঠাৎ জিপ থেমে গেল। সামনে কী যেন পড়ে। পথ বন্ধ। উল্টো দিক থেকে আসা একটা ট্রাকও থেমে গেছে। জিপ থেকে নেমে দেখি একটা প্রায় সাতফুট লম্বা পাইথন পড়ে আছে। এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে ঢোকার জন্য হয়ত পথ পারাপার হচ্ছিল। রাতের অন্ধকারে কোনও ট্রাক এসে পিষে দিয়ে গেছে। আমাদের ড্রাইভার একটা বড় রড দিয়ে তাকে পথের ধারে সরিয়ে দিল। আবার চলা শুরু।
সূর্য ঢলে পড়ছে। হলুদ কমলা রঙের বিশাল ক্যানভাসে আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে। ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। দুকিলো মিটারের মধ্যে একটি স্যাটেলাইট ক্যাম্প ছিল। সেখানে আমরা কিছুক্ষণ হল্ট করলাম। একজন সার্ভেয়ার ছিলেন। তিনি আমাদের রাতটুকু সেখানে কাটিয়ে যেত বললেন। কিন্তূ আমার স্বামী সেদিনই বেস ক্যাম্পে পৌঁছতে চাইলেন।
অন্ধকারের বুক চিরে জিপ চলেছে। কোথাও কোনও আলো নেই। আলো বলতে শুধু জিপের হেডলাইট। আর জোনাকির আলোর মালা। চোখ একটু তন্দ্রা জড়িয়ে ধরেছিল। হঠাৎ মাত্র একশো গজ দুরত্বের মধ্যে শুনতে পেলাম এক হাড় হিমকরা হুঙ্কার। হ্যাঁ, বাঘের গর্জন। সে ধ্বনি পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল। চিড়িয়াখানায় বাঘ দেখেছি। সিনেমাতেও দেখেছি। গর্জনটা মোটামুটি পরিচিত। তার ওপর রাতের অন্ধকারে নির্জন রাস্তায় যদি এমন গর্জন ভেসে আসে, তাহলে তো কথাই নেই। ড্রাইভার হায়দার আলি চিৎকার করে উঠল—শের নিকলা। ভয়ে গাড়িতে ব্রেক দিল। সেই সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা মানে যে কোনও সময় বাঘ হামলা করতে পারে। আমার স্বামী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হায়দারকে পিছনের সিটে পঠিয়ে ইঞ্জিন অন করে দ্রুত বেগে জিপ চালিয়ে দিলেন। পাশেই নালা ছিল। মনে হয় জল খেতে এসেছিল। জিপের শব্দ আর আলো হয়ত তাকে বিচলিত করেছিল। তাই এই হুঙ্কার।
খোলা জিপ থেকে এমন মুক্ত বাঘের দেখা পাওয়া অনেকের কাছেই হয়ত সৌভাগ্যের মনে হতে পারে। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে আমাদের মনের অবস্থা কী ছিল, তা শুধু আমরাই জানি।
সেদিন বাকি পথটুকু কেটেছিল রুদ্ধশ্বাসে। যখন বেস ক্যাম্পে পৌঁছলাম তখন রাত এগারোটা। ওয়াচ ম্যানরা আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হার্টমেন্টে জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল। এন টেন্টে হাতমুখ ধুতে ঢুকেছি। হাতে হ্যারিকেন। মনে হল, বালতিটা অসম্ভব ঠান্ডা। কী যেন নড়ে উঠল। ছুটে টেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। চিৎকার করে ডাকলাম সকলকে।
ওয়াচম্যান টেন্টের ভেতরে ঢুকে ‘নাগ পামু’ ‘নাগ পামু’, বলে চেচামেচি করতে লাগলো। তেলেগু ভাষায় এর অর্থ গোখরো সাপ। চিন্তাপল্লী ছিল গোখরো সাপ অধ্যুষিত। ক্যাম্পে আরও দুজন জিওলজিষ্ট ছিলেন। তাঁদের কাছে রাতের খাবার খেয়ে হার্টমেন্টের সামনে বসলাম চেয়ার পেতে। ওয়াচম্যানরা ক্যাম্প ঘিরে ধঙনি জ্বালাতে ব্যস্ত। জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে চারিদিক। সে জ্যোৎস্না কৃপণ নয়। সারা বনভূমিকে রুপোর পাতে মুড়ে দিয়েছে। হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় শান্তির আশ্বাস।