দার্জিলিঙের থেকেও উঁচু। একটা নির্জন পাহাড়ি গ্রাম। ঘুরে এসে লিখলেন রূপম রায়।
টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে/আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে/যখন তখন পৌঁছে যাওয়া যায়। নিশ্চয়ই অঞ্জনের সেই গানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!
না, সেই স্বপ্নের দার্জিলিং নয়। মাঝপথে একটু অন্য রাস্তা ধরলে কেমন হয়! ধরুন কার্শিয়াং পার হয়ে টুং–এ এলেন। টুং পেরিয়ে সোনাদাও এলেন। এবার ঘুমের দিকে না গিয়ে অন্য একটা পাহাড়ি রাস্তা ধরুন। খুব বেশিদূর নয়। মাত্র আট কিমি। চট করে চলে আসুন চটকপুরে।
এখানে দার্জিলিঙের সেই ভিড় নেই। হইচই নেই। একেবারে নিরিবিলি একটা পাহাড়ি গ্রাম। একদিকে ধবধব করছে সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাইন বনে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘের মিছিল।
দার্জিলিং এলেই গাড়িওয়ালা বা হোটেলওয়ালারা ছেঁকে ধরবে, টাইগার হিল যাবেন না! যেন ওখানে না গেলে জীবন বৃথা। কী আছে সেই টাইগার হিলে! ভোরবেলায় গেলে নাকি সূর্যোদয় দেখা যায়। সেই সূর্যোদয় দেখার কতই না হ্যাপা। ভোর পৌনে চারটের কনকনে ঠান্ডায় বেরোতে হবে। একের পর এক গাড়ির লম্বা লাইন। প্রায় আড়াই–তিন কিমি দূরে নেমে হুড়মুড়িয়ে হাঁটতে থাকুন। ভিড়ে ঠাসাঠাসি। কোনওদিন সূর্যোদয় দেখতে পাবেন, কোনওদিন পাবেন না। বেচারা রবীন্দ্রনাথ। কতবার যে এই টাইগার হিলে এসেছেন! বারেবারে হতাশ হয়েই ফিরেছেন। লতা মঙ্গেশকারের সেই গানটা। এখানেও সেই হতাশা।
আর যদি সূর্য ওঠেও, তা–ও নিজের মতো করে তা উপভোগ করবেন, তার উপায় নেই। ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি। ক্যামেরায় আঙুল রেখে ক্লিক করতে যাবেন, পেছন থেকে কেউ একটা ধাক্কা মেরে বসল। সব মুগ্ধতা কোথায় যে উড়ে গেল।
এই পর্যটকরা কেন যে চটকপুরে আসেন না! এখানে আপনি একা। দুর্গম পথ পাড়ি দিতেও হবে না। একটু হাঁটলেই দেখতে পাবেন পাহাড়ের নিচ থেকে লাল সূর্য। বলে উঠতে পারেন, লালে লাল হয়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ। একান্তে আপনি আর আপনার সঙ্গিনী। গেয়ে উঠতে পারেন, ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠে তোমায় দেখবে বলে।’
একটু যাতায়াতের হদিশ দেওয়া যাক। শিলিগুড়ি যাওয়ার ট্রেনের কথা আর নতুন করে না বলাই ভাল। অসংখ্য ট্রেন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে সেখান থেকে ৭৪ কিমি। গাড়ি ভাড়াও করে নিতে পারেন। নইলে শেয়ারে দার্জিলিঙের গাড়ি ধরুন। সোনাদায় নেমে গিয়ে আলাদা গাড়ি করে নিতে পারবেন। খরচ হয়ত কিছুটা কমবে।
সোনাদা থেকে কিছুটা পাথুরে পথ। বেশ খাড়া। দার্জিলিঙের থেকেও অনেকটা উঁচুতে। ঠান্ডাও একটু বেশি। যাওয়ার সময় পাবেন ঘন জঙ্গল। যদি ভালুক দেখতে পান, অবাক হবেন না। না, আমরা অবশ্য যাওয়া বা আসার পথে ভালুক দেখিনি। তবে আশপাশের পাহাড়ি গ্রামের লোকেদের কাছে শুনেছি সেই ভালুকের কথা। না, তাঁরা অতিরঞ্জন করছেন বা বানিয়ে বলছেন বলে একবারও মনে হয়নি। তবে ভয়ের কিছু নেই। কারণ, ওই পথ দিয়েই ওঁরা দিব্যি সোনাদা বাজারে আসেন। গাড়িতে চেপে নয়, অনেকে পায়ে হেঁটেই আসেন।
নিশ্চয় ভাবছেন, কোথায় থাকবেন! তার হদিশটাও দিয়ে রাা যাক। চটকপুর ঢোকার মুখেই পেয়ে যাবেন ফরেস্টের বাংলো। আগে থেকে বুকিং করে নিতে পারেন। জায়গা না পেলে চিন্তার কিছু নেই। আরেকটু এগিয়ে গেলে গ্রামের ভেতরেও থাকার জায়গা আছে। হোম স্টে–গুলো পাহাড়ের ওপর। ৯৬০৯৭ ৪০৪৮৯ নম্বরে ফোন করতে পারেন বিনোদ রাইয়ের সঙ্গে। একবার পৌঁছে গেলেই হল। আর আপনার কোনও দায়িত্ব নেই। পাহাড়ি সহজ সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করে যাবে।
কী এমন আছে এই পাহাড়ি গ্রামে? শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, রেস্টুরেন্ট? না, এসব কোনও কিছুই পাবেন না। একটি প্রাইমারি স্কুল ছাড়া আর কিছুই পাবেন না। গোটা গ্রাম ঘুরলে সর্বসাকুল্যে ১৯–২০টি পরিবারের দেখা পাবেন। দুদিন থাকলে চেনাজানাও হয়ে যাবে। সকাল হলেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৃষিকাজে। কৃষি বনাম শিল্প বিতর্কে বুদ্ধিজীবীদের মতো অনেক মন্তব্য করেছেন। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে, ঝুম খেতে কীভবে চাষ হয়, কৃত্রিম সার ছাড়াই জৈব সারে কী অসাধ্য সাধন করা যায়, নিজের চোখেই দেখে নিন।
যদি মিনিট দশেক হেঁটে সানরাইজ ভিউ পয়েন্টে উঠতে পারেন, তাহলে আর কথাই নেই। উত্তরের দিগন্ত জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা। দক্ষিণে পাইনের ঘন জঙ্গল। নিচের দিকে তাকালে খরস্রোতা নদী। সেই মুগ্ধতার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে পাখির ডাক। প্রকৃতির এই নির্জনতায়, পাহাড়ের ওই চূড়ায় আপনি একা। এই একাকিত্ব উপভোগ করুন।
***
বিশেষ পাহাড় সংখ্যা
জানুয়ারির মাঝমামাঝি বেঙ্গল টাইমসের বিশেষ পাহাড় সংখ্যা। বাংলার পাহাড়, বাংলার বাইরের পাহাড়। সেই সঙ্গে পাহাড় সংক্রান্ত আরও আকর্ষণীয় লেখা। এমনকী, পাহাড় সংক্রান্ত কবিতা বা গল্পও চলতে পারে। আপনিও পাঠিয়ে দিন আপনার পাহাড় ভ্রমণের কথা।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা:
bengaltimes.in@gmail.com