হারিয়ে যাওয়া কোন্নগর, হারানো সেই ছেলেবেলা

বুদ্ধদেব হালদার

ছেলেবেলার সেইসব দিনগুলো অন্যরকম ছিল। সেদিনকার সেই মফসসলের সঙ্গে আজকের এই মফস্‌সলের আকাশ-পাতাল তফাৎ।
বাবা আমাদেরকে প্রত্যেক শনিবার গঙ্গাস্নানে নিয়ে যেতেন। আমার বরাবরই জলে ভয়। বাবার হাত ধরে কিছুটা নীচে নেমে দু–‌তিনটে ডুব দিয়েই উঠে আসতুম। আমার বড়দা খুব ভাল সাঁতার জানত। বাবাকেও বহুবার গঙ্গার এপার–‌ওপার করতে দেখেছি। স্নান সেরে ঘাটের সিঁড়িতে উঠে আসতেই হাতে খুচরো কয়েকটা পয়সা দিয়ে বাবা বলত, ‘‌গায়ে কত জোর আছে দেখি ছুঁড়ে ফেল গঙ্গার মাঝে।’‌ আমি যথাসাধ্য গঙ্গার জলে পয়সাগুলো ফেলে দিয়ে গঙ্গাপ্রণাম করতাম।

তখন কোন্নগরে এত মানুষ পিলপিল করত না। কী সুন্দর রাস্তাঘাটগুলো ফাঁকা ফাঁকা দেখাত। হাতেগোনা কিছু মানুষ মাঝেমধ্যে ওলটানো নারকোল মালার মতো হেডলাইট লাগানো বড়ো সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বিকেলবেলায়। তাদের মুখগুলো কী প্রশান্তির। গা থেকে ভুরভুর করে সুন্দর সুবাস আসত।
আমাদের কোন্নগরে স্টেশন সংলগ্ন একটা খুব বড়ো বাজার আছে। আরেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড বাজার আছে সেটা কেউ কেউ জানেন। ‘‌আন্ডারগ্রাউন্ড’‌ বললাম এই কারণেই, স্থানীয় লোকজন ছাড়া সে বাজারের খোঁজ রাখা বাইরের কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বাবার সঙ্গে প্রতি রবিবার বাজারে যেতুম। তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর হবে হয়তো। জমজমাট দিনকাল ছিল সেসব।
তখনকার মানুষগুলো অন্যরকম ছিল। দেখা হলেই বড়োদের পা-ছুঁয়ে প্রণাম করতুম। আর তারা দুহাত ভরে আমাদের আশীর্বাদ করতেন। আমরা মাথা পেতে সেসব উপভোগ করতুম। ন্নগরের মাস্টারপাড়া আর নবগ্রাম(পরে) বরাবরই সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যের পীঠস্থান। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে ভাস্কর চক্রবর্তী পর্যন্ত এই মফস্‌সলে এসেছেন। মুহূর্ত কাটিয়েছেন। ভাবিত হয়েছেন। সেসব নিয়ে লিখেওছেন তাঁদের বইতে।
কোন্নগরের মনসাতলায় আমার এক পিসি থাকতেন। তার বাড়ি বেড়াতে গেলেই তিনি মালপোয়া রেঁধে খাওয়াতেন। সঙ্গে নারকোল নাড়ু। জিলিপি, দানাদার। কত স্নেহ করতেন। যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি সেসব।

তখনকার মানুষরা খুব পান চিবোতেন। আমি আমার পিসিদের দেখেছি। খেয়ে উঠে জাঁতি নিয়ে সুপুরি কাটতে বসে যেত সকলে। আর পরিবারের যে বাচ্চারা অসম্ভব জেদ ধরত পান খাওয়ার জন্য, মুখ থেকে বের করে তাদের গালে একটুকরো চিবোনো পান দিয়ে দিতেন তারা। আর বাচ্চারা সেসব দিব্যি পরম প্রাপ্তি ভেবে চিবোতো। দিনকাল পালটে গেছে। এখন ছেলেমেয়েরা পিসি তো দূরের কথা মা–‌বাবাকেও কাছে পায় না। তারা বড়ো হয় একা একা। তাদের মধ্যে একরকম মানসিক অসুস্থতা প্রথম থেকেই বেড়ে ওঠে।

দিনকাল অনেক পালটে গেছে। কতবছর আগের কথাই বা লিখলাম। যদি খুব বেশিও ধরি তো পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগের কথা হবে হয়তো এসব। এখন মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও হিংস্রতা বেড়ে গেছে। শিক্ষা ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে সম্পূর্ণ। ভদ্রতার কথা ছেড়েই দিলাম। এখন একজন মানুষ অপর মানুষের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। অন্যের কথা শোনার ধৈর্যটুকু নেই। কথা বলার আগেই একে অপরকে নিজেদের শত্রু হিসেবে মনে মনে চিহ্নিত করে ফেলে। এক যান্ত্রিকতাময় নকল জীবনে ভাসছি আমরা। কোন পথে এগোচ্ছে নতুন প্রজন্ম? কোন পথে ঠেলে দিলাম আমরা নিজেদের রক্তকে? যদি জীবনে ভালোবাসাই না থাকে তাহলে এত উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আগামীতে কী করবে তারা?

***

 

অনেক স্মৃতি জমে থাকে। না বলা কথা হয়েই থেকে যায়। ছেলেবেলার কোনও বন্ধুর কথা মনে পড়ছে ? কোনও মাস্টারমশাই বা আত্মীয়দের কথা মনে পড়ছে ? কোনও সুখস্মৃতি ভাগ করে নিতে চান ? অতীতের কোনও ঘটনার জন্য কারও কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চান ? কোনও যন্ত্রণার কথা বলে একটু হালকা হতে চান ? কারও কাছে দুঃখপ্রকাশ করতে চান ?

বেঙ্গল টাইমসের জনপ্রিয় বিভাগ – স্মৃতিটুকু থাক। এটি মূলত পাঠকের মুক্তমঞ্চ। অকপটে নিজের নানা অনুভূতির কথা লিখে জানাতে পারেন। নির্বাচিত লেখাগুলি প্রকাশিত হবে বেঙ্গল টাইমসে। শব্দ সংখ্যা ১৫০ থেকে ২৫০ ।লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ bengaltimes.in@gmail.com

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.