বিভূতিভূষণএখানে কখনওখেতে আসেননি

দিব্যেন্দু দে

একেবারেই সাম্প্রতিক একটি ওয়েব সিরিজ— রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি। পূর্ববঙ্গের একটি হোটেলের পটভূমি। সেই ভাতের হোটেলকে ঘিরে নানা ওঠা–‌পড়া। কিন্তু নামকরণেই রয়েছে অদ্ভুত এক চমক।

তেমনই একটি হোটেলের কথা। রানাঘাটের আদর্শ হিন্দু হোটেল। রানাঘাট স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বেরিয়েই চোখে পড়বে এই হোটেলটি। মনে পড়ে যাবে বিভূতিভষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। এই রানাঘাট স্টেশন সংলগ্ন একটি ভাতের ‌হোটেলকে নিয়ে লেখা তাঁর কালজয়ী উপন্যাস— আদর্শ হিন্দু হোটেল। সেই হাজারি ঠাকুর। সেই পদ্ম ঝি। আরও কত চরিত্র। যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। আটের দশকের শেষদিকে চমৎকার একটা সিরিয়ালও হয়েছিল। মনোজ মিত্র, সাবিত্রী চ্যাটার্জির সেই অভিনয়ের কথা এখনও মুখে মুখে ফেরে।

অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এই হোটেলে একদিন খাওয়ার। কিন্তু নানা কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে, একদিন সুযোগটা এসেই গেল। গিয়েছিলাম কৃষ্ণনগর। ফেরার পথে কী মনে হল, নেমে পড়লাম রানাঘাটে। অন্য কোনও কারণে নয়। স্রেফ ওই হোটেলে একদিন খাব বলেই। এই হোটেলকে নিয়ে এমন কালজয়ী উপন্যাস!‌ মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা শিহরণ কাজ করছিল। দোকানে বেশ ভিড় ছিল। ফলে, শুরুতে মালিকের সঙ্গে বা কর্মীদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার তেমন সুযোগ ছিল না। এত খদ্দেরের ভিড়ে দোকানের ইতিহাসের কথা বলতে হলে তাঁরা হয়ত বিরক্তই হতেন। সত্যিই তো, একই ইতিহাস কতবারই বা বলবেন!‌

নীচে এখন একটা মিষ্টির দোকান। নাম আদর্শ সুইটস। পাশ দিয়ে গেছে সরু সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হয় দো’‌তলায়। বেশ ছিমছাম, সাজানো। বিভূতিবাবুর ছবি টাঙানো। এখান থেকে স্টেশন দেখা যায়। ট্রেনের আসা–‌যাওয়াও দেখা যায়। বিভূতিবাবুর ভাবনায় নিশ্চয় এমন দোতলা ছিল না। সেখানে ছিল দরমার বেড়া। খড়ের ছাউনি। কলাপাতা। স্টেশন থেকে খদ্দের ডেকে আনতে হত। হাজারি ঠাকুরের রান্নার এমনই সুখ্যাতি, খদ্দেররা ঠিক ভিড় জমাত।

কিন্তু যা হয়!‌ লোকের অধীনে কাজ করতে গিয়ে নানান সমস্যা। এমনকী চুরির অপবাদও মাথায় নিতে হল। হাজারি ঠাকুরের অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল নিজের একটা হোটেল তৈরি করবেন। সেখানে নিজের হাতে রান্না করে খদ্দেরদের খাওয়াবেন। কোনও খদ্দেরকে ঠকাবেন না। কিন্তু তাঁর সেই সামর্থ্য কই?‌ এদিক–‌ওদিক থেকে টাকার জোগাড় হয়ে গেল। স্টেশনের গায়েই তৈরি হল আদর্শ হিন্দু হোটেল। মালিক হওয়া সত্ত্বেও ক্যাশবাক্স নয়, তাঁর ঠিকানা সেই রান্নাঘর।

আমি কোনওকালেই রাঁধুনি নই। চা, চাউমিন, কাজ চালানো খিচুড়ি, ডিম ভাজা— এই আমার রান্নার দৌড়। বেশি সময়ও নেই, সেই নিষ্ঠাও নেই। কিন্তু নিজের কাজটা বরাবরই যত্ন নিয়ে করি। তাই হাজারি ঠাকুরের সঙ্গে নিজের কোথায় একটা মিল পেতাম। সেই কারণেই হয়ত এই উপন্যাসটা আমার এত প্রিয়। সেই কারণেই রানাঘাটের এই হোটেলে একদিন ভাত খাওয়ার এমন তীব্র ইচ্ছে।

দোকানে একইসঙ্গে ঐহিত্য ও আধুনিকতার মিশেল। দিনের বেলায় এখনও সেই সাবেকি ভাতের হোটেল। কলাপাতা নেই, তবে কাগজের প্লেটে কলাপাতার আদল আছে। ভাত, ডাল, নানা রকমের তরকারি, ভাজাভুজি। পাঁঠার মাংস। সঙ্গে নানা রকমের মাছ। তবে সন্ধের পর চেহারা অন্যরকম। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তখন মোগলাই, চাইনিজের হরেক আয়োজন। দাম যে খুব বেশি, তাও নয়। মোটামুটি অন্যান্য রেস্তোরাঁর মতোই।

আচ্ছা, হাজারি ঠাকুর থাকলেও কি আজ এভাবেই চাইনিজ, মোগলাই করতেন?‌ হয়ত করতেন। কারণ, উপন্যাস পড়ে যেটুকু মনে হয়েছে, তিনি সময়ের দাবি বুঝতেন। খদ্দেরের চাহিদা ও তৃপ্তির কথা বুঝতেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই ভালবাসতেন। তাই তিনিও হয়ত চাইনিজ, মোগলাই আয়ত্ব করে নিতেন। ভাত, ডাল, মুড়ি ঘণ্টের সঙ্গে যখন সর্ষে ইলিশ দিয়ে গেল, মনে হচ্ছিল ভেতরে বোধ হয় সেই হাজারি চক্কোত্তি মশাই রান্না করছেন।

না, বিভূতিবাবুর সময় সত্যিই এই হোটেল ছিল না। তবে এই বাড়ির সঙ্গে তাঁর একটা নিবিঢ় সম্পর্ক ছিল। এটা ছিল তাঁর মাসির বাড়ি। মাঝে মাঝেই পথের পাঁচালির স্রষ্টা এই বাড়িতে আসতেন। থাকতেন। কখনও স্টেশনে দাঁড়িয়ে লোকজনের আসা যাওয়া দেখতেন। আবার কখনও হেঁটে হেঁচে চলে যেতেন চূর্ণী নদীর দিকে। আশপাশের কিছু হোটেল হয়ত দেখেওছিলেন। মনে মনে চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল এই কালজয়ী উন্যাস।

এই দোকানের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, সেই গোপীনাথ কুণ্ডু অবশ্য প্রথমে উপন্যাসটি পড়েননি। বিভূতিবাবুর মৃত্যুর পর এই উপন্যাস নিয়ে একটি নাটক হয়েছিল। কলকাতায় একবার সেই নাটকটি দেখেছিলেন। তখনই নামটি মাথায় গেঁথে যায়— আদর্শ হিন্দু হোটেল। এখন যেখানে, সেখানে নয়, এখান থেকে একটু দূরে। তখন ছিল মাটিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। পরে বিভূতিবাবুর স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটা কিনে নিলেন। এখানেই উঠে এল আদর্শ হিন্দু হোটেল। অনেকেই ভাবতেন, এই হোটেলেই হয়ত বিভূতিভষণ খেতেন। বা এই হোটেলকে ঘিরেই তিনি হয়ত ওই উপন্যাস খানা লিখেছেন। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, উপন্যাসটা লেখার পর, বিশেষত সেটা নাটক হওয়ার পর, এই নামের হোটেলটি তৈরি হয়। পরে আটের দশকে এই কাহিনী নিয়ে জনপ্রিয় সিরিয়াল হয়। ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় আদর্শ হিন্দু হোটেলের কথা। আশপাশের অনেকেই তখন এখানে খেতে আসতেন। যেমন এখনও আসেন। আর যেহেতু বাইরে থেকে এত খদ্দের স্রেফ এই নামটার জন্যই আসে, তাই মানটাও ধরে রাখতে হয়েছে। হাজারি চক্কোত্তির মতো না হোক, অন্তত ভাল মানের রাঁধুনি রাখতে হয়েছে। তাই ভাত–‌ডালের হোটেলে সীমাবদ্ধ না থেকে চাইনিজ–‌মোগলাইয়ের আমদানি করতে হয়েছে।

গোপীনাথবাবু নেই। তাঁর ছেলে অমরনাথ কুণ্ডু এখন ক্যাশবাক্সে বসেন। চাইলে একটু জল মেশাতেই পারতেন। বলতেই পারতেন, এখানে বিভূতিভূষণ খেতেন। কিন্তু তিনি সত্যিটাই বলেন। তিনি অকপটেই বলেন, ‘‌বিভূতিবাবু এই হোটেল দেখে যাননি। তখন এই হোটেল ছিলও না। তাঁর এই উপন্যাসের নাম অনুসারে আমার বাবা এই হোটেল তৈরি করেন।’‌ চারিদিকে যখন বাড়িয়ে বলার হিড়িক, তখন ষাট বছরে একটু জল মেশাতেই পারতেন। কোথাও একটা সংযম ধরে রেখেছেন। জানেন, কতটুকু বলতে হয়। কোনটা বলতে নেই। এই সংযমটা কজনের থাকে!‌

বিভূতিভূষণ আসুন আর নাই আসুন, এই নামটার একটা বাড়তি আকর্ষণ তো আছেই। এই বাংলায় এমন নামের হোটেলের অভাব নেই। সব জেলাতেই পাবেন। কিন্তু রানাঘাট স্টেশনের বাইরেই। সেই বাড়িতেই। আশপাশের অনেক ছবিও দিব্যি মিলে যায়। সাহিত্যের একটা গন্ধ তো আছেই। আমিও তো গিয়েছিলাম সেই গন্ধের টানেই।

 

*******

 

আহারে বাহারে

বেঙ্গল টাইমসের জনপ্রিয় বিভাগ— আহারে বাহারে। এই বিভাগে থাকবে বিভিন্ন হেরিটেজ হোটেল, রেস্তোরাঁ বা খাবারের কথা। সেটা রেস্তোরাঁ না হয়ে চা, সরবত বা মিষ্টির দোকানও হতে পারে।

কলকাতার নানা প্রান্তে এমন কত দোকান ছড়িয়ে আছে। জেলায় জেলায় এমন কত প্রাচীন দোকান ছড়িয়ে আছে।

ইতিহাসের গন্ধ মাখা সেইসব দোকান বা খাবারের কথা আপনিও লিখতে পারেন। সেই দোকানের ঐতিহ্যের পাশাপাশি মিশে থাকুক আপনার অনুভূতিও। লেখার সঙ্গে ছবিও পাঠাতে পারেন।

লেখা ও ছবি পাঠানোর ঠিকানা:‌
bengaltimes.in@gmail.com‌ ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.