গাড়ি থেকে নেমে এলেন সুচিত্রা সেন

একা সুচিত্রা, একা তিনি। একঘরে ঠিক একঘণ্টা পাঁচ মিনিট। সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থন করলেন তুষার প্রধান।

আঁধির ইন্দিরা গান্ধীকে মনে পড়ছিল খুব। আমি যখন সুচিত্রা সেনের সামনে বসে। সপ্তপদীর রিনা ব্রাউনের মুখটাও খুব মনে পড়ছিল। আমি তখন সুচিত্রা সেনের সামনে বসে। একফাঁকে তাঁর মুখে সাগরিকার সেই হাসি। মনে হচ্ছিল, একটু আগেই হারানো সুর–এর তরুণী ডাক্তার রমাকেই দেখলাম বোধহয়। একটু বাদেই গৃহদাহ–র অচলাকেও দেখা হয়ে গেল। আমি সুচিত্রা সেনের হাত ধরে ফেললাম।
আজ থেকে একুশ বছর আগের কথা। আমি এখন যে দৈনিকে কাজ করি, তখনও সেখানেই ছিলাম। রিপোর্টার হিসেবে প্রায় সমস্ত টপ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আমার জন্য নির্দিষ্ট। সে দার্জিলিং পাহাড়ের গোলমাল হোক, বা কয়লাখনির হাড়হিম করা মানুষ চাপা পড়া দুর্ঘটনা কিম্বা মায়াবতীর ইন্টারভিউ অথবা বাঁকুড়ায় হাতি বা সুন্দরবনে বাঘের পেছনে ছোটা।
এভাবেই একদিন রাতে ডিউটি সেরে অফিস ছাড়ার মুখে আমাকে বলা হল, আজ আর বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। ভোরে সুচিত্রা সেনের বেরোনোর কথা। ওই অ্যাসাইনমেন্টটা তোমার। সঙ্গে দুজন ফটোগ্রাফার ভাস্কর পাল আর শিখর কর্মকার। রাতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের অফিসেই থেকে গেলাম (‌এখন অবশ্য ঠিকানা বদল করে সেই অফিস চলে গেছে সেক্টর ফাইভে)‌। সকাল থেকেই যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি। গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা বলে নিলাম। তিনজনে তৈরি হয়ে যে জায়গায় সুচিত্রা সেনের আসার কথা, তার থেকে অন্তত পাঁচশো মিটার দূরে আড়ালে গাড়ি রেখে দিলাম। যে কাজের জন্য সুচিত্রা সেনের বেরোনোর কথা, তাতে সকাল দশটার আগে সুচিত্রার কোনওমতেই আসার কথা নয়। কিন্তু সুচিত্রা সেন বলে কথা, ওঁর জন্য নিয়ম ভাঙতে রাজি হবেন না, এমন কেউ কি আছেন! কোনও ঝুঁকি নেওয়া চলবে না। কারণ, এমন সুযোগ জীবনে বারবার আসে না। তাই তিনজনে তিনদিকে আলাদা পায়চারি। যেন এস পি জি–র লোকজন আর কী! চোখে ঘুম নেই আমাদের কারোরই। ঘুম আসার কথাও নয়। সুচিত্রা সেনের জন্য কত লোক জীবন দিতে রাজি থাকে। আর আমরা সামান্য একটা রাত জাগতে পারব না! দু’চোখে তখন ঘুম নয়, শুধুই রোমাঞ্চ।
অভিনয়ে কিছু ম্যানারিজম থাকলেও সুচিত্রা ইজ সুচিত্রা। যেমন অমিতাভ ইজ অমিতাভ। উচ্চারণ এবং স্বর প্রক্ষেপণে কিছু কৃত্রিমতা থাকলেও সুচিত্রা আমার কাছে আজও সুচিত্রা সেন। মনে পড়ে যাচ্ছিল শিল্পী ছবির শেষ দৃশ্যের কথা, যেখানে ‘ধীমান…ধীমান’ ডাকের আর্তি প্রেক্ষাগৃহে শ্রাবণধারা বয়েছিল। আমরা তখন সেই মুডি নায়িকার অপেক্ষায় যিনি শুটিংয়ের ফ্লোর থেকে খাঁচা খুলে টিয়া পাখিকে উড়য়ে দেন। পরিচালক অজয় করকে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বলেন, ‘বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল বেচারা…। তাই উড়িয়ে দিলাম..। সরি, উড়য়ে দিলাম।’ মনে পড়ে যায় তোপচাচির লেকের সেই বোটিংয়ের দৃশ্য, যেখানে ঠোঁটের অভিসারে ফুটে ওঠে, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়/ এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’ গানটি। মনে পড়ে যায় চাওয়া পাওয়া–র রিপোর্টার রজতের কথা। রিপোর্টার হিসেবে একেবারেই ফ্লপ রজত। স্কুটারে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে একটা খবর নিয়ে সে যখন হাপাতে হাপাতে সম্পাদকের ঘরে ঢোকে, তখন সম্পাদক বলেন, আর কয়েক মিনিট দেরিতে এলে এই খবরটা আর কষ্ট করে দিতে আসতে হত না। তুমি দু পয়সা দিয়ে রাস্তা থেকে কিনতে পারতে। মানে, কাগজে ছাপা অবস্থাতেই পেয়ে যেতে। রাগে, দুঃখে, অভিমানে, ক্ষোভে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে রজত। সে যে ট্রেনে পাটনায় যাচ্ছিল, সেই ট্রেনে এসেই ওঠে বাড়ি পালানো মঞ্জু। টিকিট নেই, টাকা পয়সাও কিছু নেই মঞ্জুর সঙ্গে। উদ্ধার করে রজত। মঞ্জুকে পাটনায় একটা বিচ্ছিরি হোটেলে নিয়ে গিয়ে তোলে রজত। স্বামী–স্ত্রীর মতো থাকে ওরা। মঞ্জুকে খুঁজে দিলে দশ হাজার টাকা পুরস্কার। সেই পুরস্কার রজতকে প্ররোচিত করে। এদিকে জেদি মঞ্জু ততদিনে প্রেমে পড়ে গেছে রজতের। শেষপর্যন্ত মঞ্জুর সম্পাদক বাবার কাছে তাকে পৌঁছে দেয় রজত। শেষ দৃশ্যে দেখা গেল, দশ হাজার টাকার চেকটা ফিরিয়ে দিল রজত। মঞ্জুর দেওয়া একটা আঙটিও ফিরিয়ে দিল। এর কিছুক্ষণ আগেই মঞ্জু রজতের বিরুদ্ধে উগরে দিয়েছে লোভি, নিচ, ঠগ, বিশ্বাসঘাতক— এসব নানা বিশেষণ। রজত ফিরে যেতে থাকে। পেছন থেকে মঞ্জু ডাকে, তারপর সুচিত্রা–উত্তম, যা হয়!
মনে পড়ে যায় কোন্নগরের এক রিকশ চালকের বাড়িতে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব পুনর্জন্ম নিয়েছেন শুনে মাঝরাতে সেই শিশুকে দেখতে ছুটে যান সুচিত্রা। আসলে, ১৯৭৮ সালের পর রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষা নেওয়া সুচিত্রা সেন আর সিনেমার নায়িকা বলে কিছু নন। একথাও তো জানাই ছিল। তবু কেন অপেক্ষা? সুচিত্রা সেনকে দেখা। কারণ, সুচিত্রা সেনকে দেখা যায় না, দেখা পাওয়া যায় না। মুখোমুখি হওয়া তো দূরের কথা।

অনেক ছবি হারিয়ে গেছে। সযত্নে আগলে রাখা সেই ছবি।

অনেক ছবি হারিয়ে গেছে। সযত্নে আগলে রাখা সেই ছবি।

সুচিত্রা সেনের হাত ধরলাম তো অনেক পরে। তার আগে ওর মুখোমুখি আমি একা, পাক্কা এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট।
হ্যাঁ, ইনি সেই সুচিত্রা সেন। যাঁকে দিয়ে ছবি করানোর প্রস্তাব নিয়ে একরাশ লালগোলাপ সহ তাঁর বাড়িতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন রাজ কাপুর। তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়ে রাজ কাপুর তাঁর সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সুচিত্রা পরে বলেছিলেন, মেয়েদের পায়ের কাছে যিনি ওভাবে বসে পড়েন, তাঁর ছবিতে কাজ করা যায় নাকি? এই সেই সুচিত্রা সেন, যিনি দেবদাস ছবিতে দিলীপ কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন, দিলীপ কুমারকে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় অভিনেতা হিসেবে মেনে এসেছেন। এই সেই সুচিত্রা সেন, যাঁর বাড়তে সঞ্জীব কুমার অনেকবার এসেছেন।

সুচিত্রা সেন তখন আমার সামনে বসে। যে ঘরটায় আমরা দুজনে মুখোমুখি বসে, সেখানে বসে সুচিত্রা সেন আমাকে কতটা জরিপ করেছিলেন, জানি না। তবে আমি ওঁকে যেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, তা যে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফল, মোটেও সেরকম দাবি করব না। সেদিন সুচিত্রাকে দেখে মনে হয়েছিল, মেরিলিন মনড্রো–র মতো জীবন্ত ভেনাস নন ঠিকই, কিন্তু দেবী চৌধুরানীর মতোই ব্যক্তিত্বময়ী। সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল যে ব্যাপারটি, পাহাড়ি মেঘেদের মতো দ্রুত বদলে যায় সুচিত্রার মুখের অভিব্যক্তি। সেদিন সুচিত্রাকে দেখে মনে হয়েছিল, তখনও পর্যন্ত বাংলা সিনেমা জগতে ‘স্টাইল ইজ দি উওম্যান’ যদি কাউকে বলা যায়, তবে তিনি আজও সেই ‘পথে হল দেরী’র সুচিত্রা সেন। কারা সুপ্রিয়া দেবীকে বাংলার সোফিয়া লোরেন বিশেষণ দিয়েছিলেন, জানি না। তবে সুচিত্রাকে সামনা সামনি দেখার পর, কিংবা ওঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাংলা সিনেমার কোনও তুলনীয় নায়িকার নাম মনে পড়েনি। যখন সুচিত্রাকে ক্রমাগত দেখে যাওয়ার পর্ব চলছে, তখন কী একটা কথার ফাঁকে সুচিত্রা যেন হেঁসেছিলেন। ব্রায়ান লারা যেভাবে ক্যাচ লুফতেন, সেভাবেই সুচিত্রার সেই হাঁসি ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন ভাস্কর পাল। ভাস্কর দীর্ঘদিন ধরেই মুম্বইবাসী। সম্প্রতি পৃথিবী ছেড়েই বিদায় নিলেন উদ্যমী এই ফটোগ্রাফার।

suchitra5

গ্রেটা গার্বোর মতো আড়ালপ্রেমী সুচিত্রাকে যতক্ষণ দেখেছি, ততক্ষণই অভিভূত হয়েছি। মনে মনে ভেবেছি, এ দেখা যেন শেষ দেখা না হয়। সেদিন যে ঘরে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম, সে ঘরে দুজন দুজনকে দেখা ছাড়া আর কিছু দেখার মতো ছিল না। প্রিমিয়ার পদ্মিনী গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকে সানগ্লাসটা টেবিলে খুলে রাখলেন। টেবিলের পেছনের চেয়ারে বসলেন। প্রায় সতেরো বছর আগের সেই দিনটি ছিল ১৬ জুলাই, ১৯৯৬। সুচিত্রা বসার পরে আমিও বসলাম। সুচিত্রার দু চোখ ভরে তখন অদ্ভুৎ শাসনের ছবি। গাছের ছায়ার মতো স্থিতধী মুখ। আমার মন খারাপের সমস্ত ভাষা তখন মেঘ হয়ে গেছে। বুকের ভেতরে তখন উদোম বাজনা ঘর। স্বপ্নের নায়িকার চেনা কণ্ঠস্বর বেশ কয়েকবারই ভারী ভারী ঠেকেছে। শুরুতেই আবদার করে বসেছিলাম, ম্যাডাম একটা অটোগ্রাফ দেবেন? নোটবই বাড়িয়ে দিতেই সুচিত্রা মুহূর্তের মধ্যে ‘প্রিয় বান্ধবী’–র পথচারিণীর মতো অহঙ্কারের বর্ম পরে নিয়েছিলেন। গ্রীবা ঘুরিয়ে নেন সরাসরি দেওয়ালের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ যেন গাঢ় অন্ধকারের নিস্তব্ধতা। সরহদ– এর চঞ্চলা নায়িকার মুখমণ্ডল জুড়ে সময় পর্যন্ত দোলহীন। এই অহঙ্কারের গরিমাতেই তিনি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের দেবী চৌধুরানীর কন্ট্রাক্ট। ইনি সেই সুচিত্রা সেন, আমার সেই স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। যিনি মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছেন, পেন পেন পেন/পাইলট পেন/সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা সুচিত্রা সেন।
মৌনতার সাদা অন্ধকারে ঘেরা হলঘরে বসে তখন তাঁর আত্ম মগ্নতার পুকুরে ঢিল ছুঁড়ি, সেই সাধ্য কোথায়! সে বড় কঠোর সময়। বাউল বাতাস তখন ঝড় তুলেছে মনের মধ্যে। মনে পড়ে যাচ্ছিল, হ্যাঁ, ইনিই তো একসময় বলেছিলেন, ‘আমি অভিনেত্রী, তাতেই আমার গর্ব। আমার সব অহঙ্কার। সেখানে আমি সাধারণের থেকে আলাদা।’ স্মৃতির ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল, ৫২/৪/১, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ভগ্নস্তুপের মধ্যে পড়ে থাকা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সেই সার্টিফিকেটটির কথা। নার্গিসের পর দ্বিতীয় ভারত শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হয়েছিলেন সুচিত্রা সেন, সাত পাকে বাঁধা ছবির জন্য। ৬৩ তে এই অর্জন ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁর সেই সার্টিফিকেটও যখন খন্ডহরের ভগ্নস্তুপে গড়ায়, তখনই বোঝা উচিত ছিল, সুচিত্রা আর পুরনো দিনের স্মৃতিকে আগলে রাখতে চান না। সুচিত্রার মুখের অভিব্যক্তিতে ততক্ষণে বুঝে গেছি, উনি বলতে চাইছেন— একসময় বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সিনেমা করেছি বটে, কিন্তু আজ আর সেইসব ছবি পিছু টানে না। সেই দিনগুলোকে পেছন ফিরে দেখার এতটুকুও তাগিদ অনুভব করি না।’
অথচ সেদিন এই পুরস্কার পাওয়ার খবরে এই সুচিত্রাই বলেছিলেন, ‘কাগজের পাতার খবরটা আমায় শুধু চমকে দেয়নি, বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে। তাই পুরস্কার লাভের আনন্দে তখনই বিহ্বল হয়েছি, যখন আমায় ঘিরে আমার চারপাশের সঙ্গীরা মুখর হয়ে উঠেছে। সেই আনন্দই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জয়।’
হয়ত আজ সেই ‘জয়’ তাঁর কাছে একাই মূল্যহীন। আবার তাই যদি ঠিক হবে, তবে আজও কেন হেমন্ত কণ্ঠে শোনেন ‘বসে আছি পথ চেয়ে/ফাগুনের গান গেয়ে’ । কিংবা এই পথ যদি না শেষ হয়/ তবে কেমন হতো তুমি ব ল তো।’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পুরনো সেই গান এখনও তাঁর দীনযাপনের প্রধান সঙ্গী। কানন দেবী তো ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার, বাসবদত্তা– বেশে শুধু শাড়ি পরা ছবি আছে তাঁর। কিন্তু সুচিত্রার সে ধরনের কোনও ছবি নেই। তবুও উত্তম সুচিত্রার মতো রোমান্টিক জুটি বাঙালি আজও পায়নি। সাগরিকা ছবির সেই বিজ্ঞাপনটার কথা ভাবুন— ‘প্রণয় মধুর ভূমিকায় আমাদের যুগল অভিনয়ের পথে সাগরিকা স্মরণীয় হয়ে রইল।’ তার নিচেই উত্তম সুচিত্রার স্বাক্ষর।

বাঙালি কি ভুলতে পারে উত্তমের সেই ইন্টারভিউ, যেখানে উত্তম বলছেন, — ‘রমা আমাকে উতো বলে ডাকে, ভালবাসে। এটাই বাস্তব। এটাই সত্য। দেখা গেল, একদিন সেই রমা (‌সুচিত্রা)‌ আমার বউ হয়ে গেল। হঠাৎ আমি মরে গেলাম। অনেক নারী খুঁজবে রমার হৃদয়–জুড়ে থাকা উতোকে (‌উত্তম)‌ জয় করে নিতে। এতে আলটিমেট কী দাঁড়াবে?’ এরপর উত্তমের সহাস্য মন্তব্য ছিল, ব্যাপারটা মোটেও জমবে না।

জমেনি তো আজও। তাঁর কপালে আজও টিপ ওঠেনি। সেদিন তাঁর পরনে ছিল ময়ূর নীল রঙা ভয়েলের কাপড়ে চিকনের দুরন্ত কাজ করা সালোয়ার কামিজ। পায়ে চোখ টানা সাদা চটি (‌একসময় এই সুচিত্রাই গাড়িতে পনেরো থেকে কুড়ি জোড়া জুতো রাখতেন)‌।

এদিন সুচিত্রার মুখের অভিব্যক্তি ছিল ‘ফুল বনে পাত্থর’। এরকম যখন ভাবছি, তখন সুচিত্রা একবার তাকালেন। অবিকল পাথরপ্রতিমা। সস্নেহ দৃষ্টি। বললেন, কী জানতে চাও তুমি? আমি শুনলাম, কী বলতে চাও তুমি? সকাল সেই এগারোটা পাঁচ মিনিট থেকে বারোটা তিরিশ পর্যন্ত ঠায় বসে। এরই মধ্যে ছুটে এলেন দুই যমজ যুবক— শুভঙ্কর এবং তীর্থঙ্কর দাস। সুচিত্রার প্রতিবেশী ওঁরা। সুচিত্রা সেদিন বসেছিলেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের নিচতলার স্টাফরুমে। এসেছিলেন ভোটার পরিচয় পত্র করানোর জন্য ছবি তুলতে। বাইরে তখন সচিত্র পরিচয়পত্র করাতে আসা লোকজনের ভিড়। চিৎকার, চেঁচামেচি। মুখ ঢাকতে দরজার আড়ালে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছেন সুচিত্রা। ইতিমধ্যেই টিভলি কোর্টের এক মহিলা রীনা চ্যাটার্জি (‌খান্না)‌ টের পেয়ে গেছেন, ইনিই সুচিত্রা সেন। আমার কাছে সাহস পেয়ে ভেতরে ঢুকলেন রীনা। আমার খুব মনে আছে, সাহসে ভর করে অটোগ্রাফও চাইলেন। বিরক্ত সুচিত্রা বলে উঠলেন, এরকম করলে আমি কিন্তু এখনই এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাব। পরিস্থিতি যাতে না বিগড়ায়, সেজন্য বুদ্ধিমতীর মতো ঘর থেকে বেরিয়েই গেলেন রীনা।

এবারে দোতলায় উঠতে হবে, ভোটার পরিচয়পত্রের ছবির জন্য। সুচিত্রা সেন উঠে দাঁড়ালেন। চোখে সানগ্লাস চড়ালেন। জানতে চাইলাম, ভোট দেন? ঘাড় নাড়লেন। ‘চতুরঙ্গ’— তে অভিনয়ের ইচ্ছে ছিল আপনার। এখন আর সে ইচ্ছে হয় না? রা কাড়লেন না সুচিত্রা।

আপনার এই স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবন কীভাবে কাটানোর ইচ্ছে?
কোনও জবাব দিলেন না বটে। তবে একটু নরম সফেন হাসি খেলল তাঁর মুখে। এক হাতে মুখের একাংশ ঢেকে চলতে শুরু করলেন। আমি ওঁকে হাত ধরে এবং কোমরে একটু সাপোর্ট দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সাহায্য করলাম। সুচিত্রা কিন্তু তখনও আমাকে সাংবাদিক ভাবেননি। তাই স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা নিয়ে প্রশ্ন করায় হয়ত মজাই পেয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, রুশ লোকগাঁথার সেই প্রবাদ বাক্যটা— ‘তোমার একান্ত স্বপ্নের সংখ্যা এক। সুতরাং কখনই তা তুমি দ্বিতীয় কাউকে বলবে না।’

ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেই আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলেন সপ্তপদীর রিনা ব্রাউন। আমি তো না হয় এতক্ষণ বকবক করেছি। কিন্তু চিত্র সাংবাদিকদের যে তখনও ছবি তোলা হয়নি। তারা আর কতক্ষণই বা অপেক্ষা করবে! তাছাড়া, সামনে সুচিত্রা থাকলে কার আর সংযম থাকে! তাদের জীবনেও তো এমন মুহূর্ত এই প্রথম। রোমাঞ্চ আসাই তো স্বাভাবিক। দুই চিত্র সাংবাদিকের ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠতে লাগল ঘনঘন। বিরক্ত সুচিত্রা আদেশ করলেন, স্টপ ইট। স্টপ ইট। বুঝেছিলাম, সুচিত্রা কমান্ড হারানননি।
বুঝে গেছেন, তিন সাংবাদিকের ঘেরাটোপে পড়ে গেছেন তিনি।
সিঁড়ি পথ ভেঙে গেটের মুখে ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলায় বাধা দিতে ওড়না খুলে মুখের সামনে দোলাতে লাগলেন স্কুল বালিকার মতো। ওড়নায় মুখ ঢাকতে ঢাকতে সেই কালো প্রিমিয়ার পদ্মিনীতে গিয়ে উঠলেন, যেটার চালকের আসনে ততক্ষণে বসে গেছেন শুভঙ্কর। গাড়ি কিছুদূর গিয়ে থামল হালদার সুইটসে। গাড়ি থেকে নামলেন সুচিত্রা। সেই দোকান থেকে এক বাক্স মিষ্টি কিনে তুলে দিলেন শুভঙ্করের হাতে। শুভঙ্করের আপত্তি নাকচ করে দিয়ে বললেন, ‘তোর মা দিচ্ছে রে, নে।’

দেওদার স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের কাছে গিয়ে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে যেই দেখলেন দুই চিত্র সাংবাদিক তক্কে তক্কে রয়েছেন, অমনি সুদর পা দুটি গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। আমাদের এড়াতে সুচিত্রা আর গাড়ি থেকে নামলেনই না। সোজা চলে গেলেন মুনমুনের বাড়ি। গাড়ির কাঁচের জানালায় কিন্তু তখন লিপগ্লস মাখা ঠোঁটে সুচিত্রা সেনের ভুবনমোহিনী হাসি। সাংবাদিক এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘জয়’এর হাসি।

তিনি না হয় এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু আমরা! আমাদের জয় যে আরও বড়। গর্ব করে বলতে পারব, আমরা সুচিত্রা সেনকে দেখেছি। বলতে পারব, আমি সুচিত্রা সেনের হাত ধরেছি। সাংবাদিকতা এমন এক পেশা, যা অনেক সেলিব্রিটির কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর ইন্টারভিউ নিতে গিয়েও এমন রোমাঞ্চিত হইনি। কিন্তু সুচিত্রার ইন্টারভিউ বলে কথা। এই শিহরন একুশ বছর পরেও আছে। সারাজীবন থাকবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.