পৃথা কুণ্ডু
করোনা-আতঙ্কে দিনগুলো কাটছে দুর্বিষহ। তার সঙ্গে মাঝে যোগ হল আম্ফান–বিপর্যয়। গৃহবন্দি জীবনের স্ট্রেস কাটাতে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন গানবাজনা, লেখালেখির মতো সৃজনমূলক কাজে। অনেকে রসিকতা করে জোকস, মিম ছড়াচ্ছেন নেট দুনিয়ায়। আবার অনেকে বলছেন, এই সময় সাহিত্য–কলাবিদ্যার চর্চা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা মানে এক অসুস্থ মানসিকতার পরিচয়, এত মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি সংবেদনশীলতার অভাবই তাতে প্রকাশ পায়। তাহলে যাব কোনদিকে?
বিরাট মাপের বুদ্ধিজীবী নই, সেলিব্রিটি–স্তরের শিল্পী–সাহিত্যিকও নই। মনেপ্রাণে যা-ই হই না কেন, পেশাগত জীবনে এক সাধারণ শিক্ষক – যাকে অনলাইন ক্লাস নিতে হয় খানিক কর্তব্যের তাগিদে আর ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে, আর কিছুটা সরকারি নির্দেশেও। পড়াতে হয় রোমান্টিক কবিতা। ক্লাসরুমে সরাসরি তাদের প্রাণবন্ত মুখগুলো দেখতে দেখতে কবিতা পড়ানো এক জিনিস; আর অনলাইনে একটা যান্ত্রিক আবহের মধ্যে, অনিশ্চয়তার মাঝে ঢুকে পড়া চোরা বৈষম্যের চাপে নিজের কাছেই অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে ‘রোমান্টিকতা’ বোঝানো সম্পূর্ণ আলাদা। কারও বাড়ি গ্রামের দিকে, নেট কানেকশন দুর্বল, কারও বা বাড়িতে একটি মাত্র স্মার্টফোন – সেটাকে নিয়ে বাবা, দাদা, মেয়ে সবারই প্রয়োজন মেটাতে হয়। কাউকে সারা সকাল রেশনের লাইনে দাঁড়াতে হয় বলে ক্লাসে আসতে পারে না এক এক দিন। কেমন করে এই অবস্থায় বোঝাবো ‘টিনটার্ন অ্যাবে’র ‘আ সেন্স সাব্লাইম’, ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড’-এর বিধ্বংসের মাঝে বেজে ওঠা জীবনের বাঁশি, ‘ওড অন আ গ্রিসিয়ান আর্ন’-এর ‘হার্ড মেলডিজ আর সুইট, বাট দোজ আনহার্ড’-এর অনির্বচনীয় মধুরতা? তবু পরীক্ষাটা ওদের কোনও না কোনও ফর্মে দিতে হবে, ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হবে – পড়াটা তাই চালিয়ে যেতেই হবে।
‘টিনটার্ন অ্যাবে’ পড়াতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলাম গতমাসে। একটা মানুষ বলছে- আমার সব যন্ত্রণার উপশম খুঁজে পাই প্রকৃতির মধ্যে। জীবনের জটিলতা থেকে মুক্তির আশায় ছুটে যাই তার কাছে। অথচ এটা জীবন থেকে, মানুষের দুনিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়। প্রকৃতির বুকে কান পাতলেই শোনা যায় ‘দ্য স্টিল স্যাড মিউজিক অব হিউম্যানিটি’। কেমন করে সম্ভব? প্যানথেইজম আর হিউম্যানিজম এর চচ্চড়ি বানিয়ে গিলিয়ে দেওয়ার সময় এটা নয়। তাও একটু চেষ্টা করে দেখলাম, কারও মাথায় ঢুকছে না এসব। আমারও ভাল লাগছে না। অগত্যা ‘স্টিল স্যাড মিউজিক অব হিউম্যানিটি’তে এসে থামতে হল। বললাম, ‘আজ এই পর্যন্ত থাক। এইটুকু নিজেরা কয়েকবার পড়ে পরের দিন এসো। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?
একজন বলল, ‘লাস্ট লাইনটা ঠিক বুঝলাম না ম্যাডাম। মানুষের দুঃখের সুর? দুঃখের ফিলিং হতে পারে, কিন্তু মিউজিক বলতে? তাও আবার নেচারের মধ্যে থেকে শোনা যাচ্ছে?’
ঠিক কীভাবে বলব ভেবে পেলাম না। পাল্টা বললাম, ‘বাকিদেরও কি এই জায়গাটাই অসুবিধে হচ্ছে? কার কী মনে হচ্ছে একটু বল।’
আর একজন বলল – ‘কান্নার আওয়াজ মিন করছে কি?’
মনে হল, একটা সূত্র পেয়েছি ওদেরই ভাবনার রাস্তায় উঁকি মেরে। বললাম, ‘হতে পারে – তবে সে কান্না বাতাসে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। এমনি শোনা যায় না। খুব গভীর ভাবে কান পাতলে শোনা যায়। একটা জিনিস শোনাই, তিন-চার মিনিট লাগবে। ভাল করে শোন।’
সামনে ল্যাপটপ খোলা ছিল, চালিয়ে দিলাম – ‘তুমি রাতের সে নীরবতা… শুনেছ কি মানুষের কান্না/ বাতাসে বাতাসে বাজে/ তুমি শুনেছ কি…
বেলা বারোটা তখন। লকডাউন চললেও দু চারটা মোটর সাইকেলের আওয়াজ, চারপাশের টুকটাক অস্থিরতা এসব কানে আসে এমনিতে। কিন্তু থেমে গেল সব – কলরব, কোলাহল… অসীম আকাশের নীচে শুধুই জেগে রইল ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট আশা, যার খবর কেউ রাখে না।
গানটা শেষ হতে কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপচাপ।
একজন নীরবতা ভাঙল, ‘এবার বুঝতে পেরেছি।’
বললাম, ‘যা বুঝেছ, লিখে পাঠিও। হোমটাস্ক রইল।’
তাগাদা দিতে হয়নি, অনেকেই লিখে পাঠিয়েছিল ইমেইলে। ভাষা ঠিকঠাক করে দিতে হয়েছিল, ভাবের খামতি হয়নি কারও লেখাতেই। টিনটার্ন অ্যাবে পড়াচ্ছি গত সাত বছর ধরে – এতটা সার্থক আগে কোনদিন মনে হয়নি নিজেকে।
‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ ধরেছিলাম তার পর-পরই। রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’, মোহিতলালের ‘কালবৈশাখী’-র সঙ্গে তুলনা এমনিতেই করে থাকি। তখনও জানি না আম্পানের পূর্বাভাস। ‘টিনটার্ন অ্যাবে’-র অনুষঙ্গে ‘ নীল আকাশের নীচে’ গানটা বোধহয় ওদের খুব ভাল লেগেছিল। নিজেরাই জানতে চাইল, ‘ওয়েস্ট উইন্ড-এর সঙ্গে মিলিয়ে কিছু গানের রেফারেন্স হয় না?’ কয়েকটা গানের কথা বলেছিলাম। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’, ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি’, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’… সেই সঙ্গে ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’, ‘তুফান আয়া রে’। ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা ওদের ভাল লাগছে যখন – এই নিয়ে একটা প্রজেক্ট করতে দিই। ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেণ্ট হিসেবে রেকর্ড থাকবে। দশ দিন সময় দিয়েছিলাম।
ঝড়-তাণ্ডবের পর ক’দিন নেটওয়ার্ক ছিল না সকলের এলাকায়। ক্লাস বন্ধ রেখেছিলাম তাই। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতে দেখলাম, ওরা আবার ক্লাসে ফিরেছে। কার এলাকায় কী অবস্থা, সবাই নিরাপদে আছে কিনা – এইসব খবর নিতে নিতেই অনেকটা সময় গেল। নতুন একটা টেক্সট ধরেছিলাম। সেটাই একটু আলোচনা করে ছেড়ে দিতে যাব, তখন ওরাই বলল – প্রজেক্ট তাহলে কবে পাঠাব ম্যাডাম? আর একটু সময় পেলে ভাল হয়।
আমিই ভুলে গিয়েছিলাম। এই বিপর্যয়ের পরও ওরা যে মনে রাখবে, বিপদ কাটিয়ে উঠে কাজটা শেষ করতে আগ্রহ দেখাবে, ভাবতে পারিনি।
গান, কবিতা, বাস্তব, বিপর্যয়, পড়াশোনা, বেঁচে থাকার লড়াই, সংবেদনশীলতা, জীবন – সবই সত্যি। কিন্তু সব কিছুকে বোধহয় একটা নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে ফেলা যায় না।