ড. অরিন্দম অধিকারী
আটের দশকে পড়তে পড়তে অনেক না বলা কথা বোঝাতে চেয়েছিল ‘কিশলয়’। আজ তা জীবনের প্রতিটি আঁকে বাঁকে চরম সত্য। তিস্তা নদীর ধারে বস্তির তখনকার মোস্তাফার বাদাম পেস্তা তো দূর, ভাতে জুটত আস্ত পেঁয়াজ আর কখনও সখনও পোস্ত বাটা। ‘ঐ যে দুরে পাহাড়ের চূড়া। নীচে ময়ূরবনের হাট’। আজ লকডাউনের জন্য বন্ধ, যেখানে ভূষণ তার দিদির বানানো ধূপকাঠি বেচে গামছা কেনারও পয়সা জোগাড় করতে পারছে না। লকডাউন না হলে বোঝাই যেত না কত মোস্তাফা ভূষণরা আজ আরও বেশি বেশি করে পরিযায়ী। কিশলয়ের মোস্তাফা–ভূষণদের লড়াইটা আজও ভাতের। জাতের জন্য নয়।
লকডাউনের মধ্যেই যে রেবা চালাঘরে থাকে, তার ঘরের চালা উড়ে যায় আম্ফান ঝড়ে কিংবা আজকের কোনও এক অর্জুন সর্দার মাছ ধরার আশায় দেখে সুন্দরবনের বেশিরভাগ বাঁধগুলোতে ফাটল ধরেছে। আশঙ্কায় হিম হয়ে যাওয়া আজকের অর্জুনরা আজও গাঁয়ের দিকে ছোটে আর চিৎকার করে বলে, ‘বাঁধ ভাঙছে, ঠেকাতে হবে, চলো সবাই’। একসঙ্গে বাঁচার লড়াইয়ের পাঠ শিখিয়েছিল কিশলয়। সম্প্রীতির পালে হাওয়া তুলে দুই বন্ধু প্রভাত ও আক্রাম বেত্রবতীতে নাও ভাসিয়ে সমবেত হয় তালপুকুরের মাঠে স্বাধীনতার যুদ্ধ দেখবে বলে। কিশলয়ের বিক্রমপুরের শ্রীকান্ত অধিকারীর দলের যাত্রাপালা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ এর বুড়ো চাষির ওপর মহাজনী অত্যাচার আজও আছে। শ্রমের সঠিক মূল্যের ঠিকানাতে পৌঁছতে চাই আরও ঐক্যবদ্ধ কিষান সমাজ। অসহ্য পেটের ব্যথায় দাদা অমূল্যর কাতরানোয় বিহ্বল হয়ে আজও কোনও শ্যামল গভীর রাত্রিতে দু’মাইল হেঁটে যায় ডাক্তার ডাকতে। কিশলয়ের আজকের শ্যামলরা লকডাউনে বেরিয়ে আসা বাজেটে নামমাত্র বরাদ্দ, কঙ্কালসার ভেঙে পড়া সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক একটা বঞ্চনার শিকার। লকডাউনের আগে বা পরে আজও কি কোনও মৃন্ময়, চিন্ময় তার দিনু চাচার বাড়ি যাওয়ার রাস্তার শোভা তন্ময় হয়ে দেখে? কিংবা আনন্দে আত্মহারা মন্মথবাবুরা ঝিলমের তীরে দাঁড়িয়ে কি আজও বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ। দিঘীভরা পদ্মফুল দেখেছি। কিন্তু একসঙ্গে এত গোলাপ দেখিনি কখনো।’ লকডাউনে ঘরে বসে দেশভাগের যন্ত্রণায় বিদ্ধ ভুবন ভট্টাচার্য্যের মতো দাদুরা হয়তো তার নাতি চিত্তদের সুন্দরবনের শিবসা নদীর ধারে হেতালের ডালে বসে থাকা সারি সারি বক মাছরাঙা দুধরাজের গল্প শোনায়। জীব বৈচিত্র্য বাঁচা মানে পৃথিবীর বেঁচে থাকা। কিশলয় হয়তো নিশঃব্দে সেই পাঠ দিতে চেয়েছিল। কিশলয়ের পরেশরাই চটকলে আজও কাজ করে। কারণ, তারাই দেশের ভরসা, সভ্যতার পিলসুজ।
আসলে এই কঠিন সময়ে যে বাংলায় করোনাকে ‘পাশবালিশ’ করে শুতে হবে কিংবা যে ভারতে আশিজন শ্রমিককে প্রাণ দিতে হয় ঘরে ফিরবে বলে বা প্রসূতি শকুন্তলাকে ভারতের রাস্তায় ভরতের জন্ম দিতে হয়, সেই ভারতে আজ আরও বেশি বেশি করে কিশলয়ের মৃদুলের বাবা মৃগেনবাবুর মতো নেতার প্রয়োজন। যিনি কাউকে ঘৃণা করেন না। কৃষক–মজুর সবাইকে ভালোবাসেন। আমরা ঘুরে দাঁড়াবই। করোনা মুক্ত পৃথিবী একদিন হবেই। কিশলয়ের রানা মালার মতো আমাদের বাড়ির কচিকাঁচারা বাবা মায়ের হাত ধরে আবার ওপাড়ায় গান শুনতে যাবে। যেখানে বাদল গান গাইবে, নারান তবলা বাজাবে আর হাসান বাজাবে সানাই।