১৩ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব বেতার দিবস। অনেকের স্মৃতিতে রয়ে গেছে কাঠের বাক্সের সেই রেডিও। এখন রেডিওতে মন কী বাত হয়। কিন্তু সেই ফেলে আসা রেডিওকে নিয়ে আমাদের মনের কথাটা ঠিক কী? নস্টালজিয়ায় মোড়া দারুণ এক লেখা উপহার দিলেন সন্দীপ লায়েক।
গ্রামের বাড়ির পর্দাঘেরা তাকের ওপর জমানো, বাতিল জিনিসপত্রের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল রংচটা বস্তুটা। ঠিক যেন ছোটখাট একটা কাঠের বাক্স। পিছনে পিচবোর্ডের শক্ত একটা পাটা, প্যারাসুট সুতো দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। চারটে হাতে-ঘোরানো স্ক্রু দিয়ে আঁটা থাকত সেইসময়। সামনে ছিল তিনটে নব। তাদের মধ্যে কালো এবং সবচেয়ে বড়টাই অবশিষ্ট রয়েছে আজও। বাকি দুটো বয়সের ভারে, অবহেলায় মাথা-ভেঙ্গে কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে।
বড়টা ব্যবহার করা হত টিউন করানোর কাজে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। ওপরে স্কেলের মত স্বচ্ছ জায়গাটার ভেতরে ফাতনার মত কাঠিটাকে সরিয়ে এনে করতে হত ব্যাপারটা। শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যে আচমকাই ভেসে আসত কথা বা গানের শব্দ, ঠিক পরমুহূর্তেই যেটা হারিয়ে যেত। আবার খুব সূক্ষ্মভাবে স্পর্শ করে পাওয়া যেত আসল মধুর শব্দটা। সে যেন এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার!
নীচের প্রথম নবটা ব্যবহার হত ভল্যুম কমানো-বাড়ানোর কাজে। আর দ্বিতীয়টা ছিল শর্ট ওয়েভে সন্ধ্যে সাতটায় BBC লন্ডনে বাংলায় খবর শোনার জন্য।
আমার যখন জন্ম হয় সেটা আশির দশকের এক্কেবারে শুরু। কাজেই এসব রেডিও হাত দিতে গেলে বড়রা সবাই জোর ধমক দিত। শুধু ব্যাটারি শেষ হলে, গলে যাওয়া বড় অ্যাভারিডি ব্যাটারি গুলো নিয়ে খেলার অধিকার ছিল। বিজ্ঞানী কাকারা যখন পিছনের স্ক্র খুলে ব্যাটারি পাল্টাত আমি মস্ত হাঁ করে দেখতাম। সরু চ্যাপ্টা মাথা যন্ত্রাংশগুলোর মাঝে জ্যান্ত কথাবলা-গান গাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজতাম!
রেডিওটা নাড়াচাড়া করতে পেতাম শুধুমাত্র দুটো সময়। এক – কোনও সপ্তাহান্তের বিকেলে যখন ছোটকাকু সাইকেলের চাকাগুলো ওপরের দিকে করে শুইয়ে চেনে মোবিল দিতে দিতে রেডিওতে গান শুনত আর ভাল সিগন্যালের জন্য আমায় সেটা ঘোরাতে বলত। আর দুই – প্রত্যহ সন্ধ্যার খবর এবং স্থানীয় সংবাদ শুরুর আগে দাদুর যখন ডাক পড়ত, বাবা-কাকাদের কাছ থেকে রেডিওটা আনার জন্য।
সেসময় গ্রামে কোন টেলিভিশন ছিল না, ছিল না ইলেকট্রিসিটি। এমনকি ছিল না কোনও টিউবওয়েলও। মহালয়ার দিন ভোরে পাশাপাশি বাড়ির লোকজন চলে আসত মহালয়া শুনতে। কেউবা সে রাতটা থেকেই যেত।
সন্ধ্যে সাতটার খবরটা শুনতাম প্রায় নিয়মিতই। উঠোনের মস্ত পেয়ারা গাছটার তলায় দাদুর পাশে পাটের-দড়ি খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে বা ঠাকুমার পাশে মুড়ি খাওয়া চাঁদবুড়ি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তাম কখন। একটা ছোট্ট বাছুর ঘুমাত খাটের তলায়। সাড়ে সাতটার খবরটা কে যে পড়তেন সঠিক মনে নেই। তবে পরিষ্কার মনে আছে ঠিক সাতটা-পঞ্চাশ বাজলেই পরিছন্ন গলায় ভেসে আসত “আকাশবাণী কলকাতা, স্থানীয় সংবাদ পড়ছি বরুণ মজুমদার। এখনকার বিশেষ বিশেষ খবর হল …”। বেশ মনে আছে খবরের মাঝে সেই অ্যডভাটাইজমেন্টের কথাগুলোও -“কপিলা বসু আহার কি আর এমনি এমনি খাওয়াই?” পাশ থেকে গরুটা ডেকে উঠত -অঁ।