বইমেলার দাদাঠাকুর

নিজের পত্রিকা নিজেই ফেরি করে বেড়ান। হাসিমুখে অন্যদের হাসিয়ে যান। এমনই এক চরিত্রকে তুলে ধরলেন পারিজাত সেন।

বিরাট বইমেলায় তাঁর কোনও স্টল নেই। আসলে, গোটা বইমেলা চত্বরই তাঁর স্টল। একমুখ দাড়ি। বুকে ও পিঠে ঝোলানো লম্বা পোস্টার। দুহাতে অসংখ্য ছোট ছোট বই। দু’হাত তুলে তিনি হেঁকে চলেছেন— মাত্র পাঁচ টাকা। পড়বেন কুড়ি মিনিট। হাসবেন একঘণ্টা। পড়া শুরু হবে, হাসি শুরু হবে। পড়া থামবে, হাসি থামবে না।
কণ্ঠস্বরটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে! একটু স্মৃতি হাতড়ে পুরনো বইমেলাগুলোতে ফিরে যান। মুখটাও এবার নিশ্চয় মনে পড়ছে। হ্যাঁ, ইনি অলোক কুমার দত্ত। বইমেলার সুখ–দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সেই শুরু থেকেই। বড় সেলিব্রিটি নন, স্টল জুড়ে তাঁর বইয়ের সম্ভার নেই, তাঁর বই কিনতে লম্বা লাইন পড়ে, এমনও নয়। কেউ কখনও তাঁর অটোগ্রাফ চেয়েছে কিনা, তা–ও জানা নেই। তবু তিনি সাহিতের ফেরিওয়ালা। বইমেলায় তিনিও স্বতন্ত্র এক চরিত্র।

book fair5

হেঁকে হেঁকে বই বিক্রি করার অভ্যেসটা সেই ১৯৭৫ থেকে। প্রথম বইমেলা থেকেই জড়িয়ে গেছেন এই উৎসবের সঙ্গে। তাঁর কথাতেই শোনা যাক। শুরুর বইমেলার সময় আমার নিজের কোনও পত্রিকা ছিল না। আমার দাদা–কবিরা আর বন্ধুরা মিলে বের করত কণ্ঠস্বর। আমি হেঁকে হেঁকে বিক্রি করতাম। সবাই যে স্টলে এসে কিনে নিয়ে যাবে, এমন আশা করাও ঠিক নয়। তাই স্টলে বন্দি না থেকে গোটা মাঠ জুড়ে বিক্রি করাই ভাল। অনেক বেশি লোকের কাছে পৌঁছনো যায়। তারপর ১৯৮৭ নাগাদ চালু করলেন নিজের পত্রিকা স্বয়ংনিযুক্তি। শুরুতেই কবিতা সংখ্যা। তারপর করলেন হাসি সংখ্যা। হুড়হুড় করে সব বিক্রি হয়ে গেল। তৈরি হয়ে গেল সেই অভিনব স্লোগান। যা আজও প্রাণবন্ত। একই ক্যাপশন দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষকে আনন্দ দিচ্ছে, এটা অন্য দেশ হলে হয়ত ‘ক্যাপশন অফ দ্য ডিকেড’ বা অন্য কিছু পুরস্কার পেত।
হেঁকে হেঁকে বিক্রি করেন। অনেক চেনা মানুষের সঙ্গে নিশ্চয় দেখা হয়ে যায়। তখন সঙ্কোচ হয় না! বাংলা আকাদেমি চত্বরে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘কে যে কীসে লজ্জা পায় আর কে যে কীসে গর্ব অনুভব করে, তা বোঝা খুব মুশকিল। একজন মাতাল মদ খেয়ে রাস্তায় চিৎকার করতে করতে যায়। ভাবে সে বোধহয় দারুণ মূল্যবান কথা বলছে। অনেক বড় বড় মানুষও এমন কাজ করে, যা বেশ হাস্যকর। কিন্তু তারা ভাবে, তারা বুঝি দারুণ কিছু করছে। তাছাড়া, চুরি–ডাকাতি তো করছি না। নিজের পত্রিকা নিজে বিক্রি করি। লজ্জা পেতে যাব কেন? দাদাঠাকুরকে নিশ্চয় জানেন! তিনিও কিন্তু নিজের পত্রিকা নিজেই হেঁকে হেঁকে বিক্রি করতেন। তাঁর মতো মানুষ যদি পারেন, আমার প্রেস্টিজে লাগবে কেন? আমি নিশ্চয় তাঁর চেয়ে বড় নই। আমার অনেক পরিচিত লোক অবশ্য বলে, কেন ভাঁড়ের মতো বই নিয়ে চিৎকার করিস? আমি তাদের বলি, আমি ভাঁড় হতে পারি, ছোটলোক তো নই।
বইমেলা আসে, বইমেলা ফুরিয়েও যায়। বাকি সময়টা তাহলে কী করেন? আসলে, অলোকবাবু পেশায় কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। ছোট থেকেই আঁকার শখ। তাই ভর্তি হয়ে গেলেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। আঁকার কাজের পাশাপাশি চলল আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটক। না, কোনও তারকা কবির কবিতা নয়, কবিতা খুঁজে বের করেন লিটল ম্যাগ থেকে। আর তাঁর শ্রুতিনাটক কখনও উঠে আসে সতীনাথ মুখার্জি, কখনও দেবরাজ রায়ের কণ্ঠে। বিদেশেও বেশ কিছু জায়গায় অভিনয় হয়েছে তাঁর লেখা শ্রুতিনাটক। আর শীত এলেই মন ছুটে যায় বইমেলায়। শুধু কলকাতা বইমেলা নয়। বিভিন্ন জেলার বইমেলায় ঠিক পৌঁছে যান। পৌঁছে যান প্রতিবেশী রাজ্যেও।
কী রকম বিক্রি হয়? কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর ছুঁড়ে দিলেন পাল্টা রসিকতা, ‘কত লিখবেন? তার চেয়ে আপনি বরং লিখুন, ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলায় কে আর জড়াতে চায়’‌?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.