উঠল বাই, শিমূলতলা যাই। হঠাৎই চলে যাওয়া। তাও প্রায় ষোল বছর আগে। সারাদিন টেনে ঘুম, রাতে হ্যাজাক নিয়ে বেরিয়ে পড়া। এমনই নৈশ অভিযানের স্মৃতি উঠে এল সৌম্যদীপ সরকারের লেখায়।
তখনও মোবাইল নামক বস্তুটি এতটা গণহারে ছড়িয়ে যায়নি। স্মার্টফোন, জিও–ডেটা এসব শব্দগুলি তখনও আম বাঙালি শোনেনি। ‘অনুপ্রেরণা’ নামক শব্দটি ডিকশেনারিতে থাকলেও যত্রতত্র তার ব্যবহার ছিল না। কারও কারও মোবাইল থাকলেও ফোন এলেই ইনকামিংয়ের জন্য মিনিট পিছু তিন টাকা গচ্চা যেত।
তেমনই একটা সময়ে হঠাৎ করে শিমূলতলা অভিযান। কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। গুগল নামক সিধু জেঠুর কাছে রুট জানার উপায়ও ছিল না। সেই উঠল বাই, শিমূলতলা যাই। আসলে, গিয়েছিলাম ডিসেরগড়ে, ছিন্নমস্তা মেলায়। সেখান থেকেই ‘ভূত’ নিয়ে নানা আলোচনা। তখনই একজন বলল, শিমূলতলায় ভূত দেখতে গেলে কেমন হয়! ধ্বনি ভোটে প্রস্তাব পাস। আমি তখন কলেজের ছাত্র। বয়সে সর্বকনিষ্ঠ। আমার আপত্তি ধোপে টিকল না। আমার অবশ্য শিমূলতলা নিয়ে আপত্তি ছিল না। বলেছিলাম, ভূত বলে বস্তুই যখন নেই, তখন তা দেখতে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। বেড়াতে যাচ্ছি বললে আপত্তি নেই, কিন্তু ভূতকে টেনে আনা কেন? সংখ্যাগরিষ্টের রায়ে আমার যুক্তি ধোপে টিকল না। ঠিক হল, শিমূলতলাই যাওয়া হবে, এবং ভূত দেখাটাই মূল এজেন্ডা। সভা থেকে ওয়াক আউট নয়। বরং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার সেই তত্ত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়কে শিরোধার্য করেই পাড়ি দিলাম।
কোন ট্রেনে গিয়েছিলাম, কোথায় গিয়ে নেমেছিলাম, এতদিন পর আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, ভোরেই ট্রেনে উঠেছিলাম। বোধ হয় ঘণ্টা তিনেক লেগেছিল। অনলাইন বুকিং নামক শব্দটা তখনও আমরা শুনিনি। নেমে শুনলাম, হোটেল–ফোটেল তেমন কিছু নেই। কারও বাড়িতেই থাকতে হবে। একটা ঠ্যালা ভ্যান জুটল। সে–ই একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। আসার পথেই দেখছিলাম, একের পর এক বাড়ি। বাইরে তালা ঝোলানো। দরজায় শ্যাওলা জমে। কোনও অনুপ্রেরণা ছাড়াই নিজের নিয়মে লতা পাতা গজিয়ে গেছে। কেউ থাকে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে কেউ এসেছে বলেও মনে হয় না। তাহলে এগুলো কাদের বাড়ি? কারা বানিয়েছেন? কেনই বা বানিয়েছেন? নানা প্রশ্ন তখন উকি দিচ্ছে। কিন্তু কাকেই বা প্রশ্ন করব? কেউ তো নেই। অগত্যা, নিজেরাই প্রশ্ন করছি। নিজেরাই মনে মনে উত্তর সাজাচ্ছি। বাঙালি একসময় পশ্চিমে যেত। বাঙালির পশ্চিম বলতে এইসব জায়গাগুলোই বোঝাতো। কয়েকদিনের হাওয়া বদল। গল্পে–সিনেমায় পড়েছি, দেখেছি।
আমাদেরও ঠাঁই হল তেমনই এক বাড়িতে। কেয়ার টেকারের দেখা পেলাম। উঠোনের ভেতর কুয়ো। দড়ি, বালতি আছে। নিজেদেরই তুলে নিতে হবে। মনে পড়ে গেল অরণ্যের দিনরাত্রির কথা। পালামৌ এর জঙ্গলে এমন কুয়োতেই তো স্নান করতে দেখা গেছে সৌমিত্র, শুভেন্দু, রবি ঘোষ, সমিত ভঞ্জদের। আমরাও না হয় সেভাবেই করব। কিন্তু খাওয়ার জায়গা কোথায়? কেয়ারটেকার একটা হোটেলের সন্ধান দিলেন। অর্ডার দিয়ে রাখলে রান্না করে রাখে। ঠিক হল, আগামী দুদিন আমরা সেখানেই অন্নগ্রহণ করে কৃতার্থ করব।
সবাই রাত ভোরে উঠেছে। ভোরে ওঠার অভ্যেস আছে, এমন দুর্নাম কাউকেই দেওয়া যাবে না (এমনকি আমাকেও না)। যখন তোমার ঘুম ভাঙবে, তখন তোমার সকাল— এই ঐতিহাসিক গানটা তখনও লেখা হয়নি। কিন্তু আমাদের সকাল আমাদের মতো করেই হত। শিমূলতলায় পৌঁছেই সবার যেন একটাই ডেস্টিনেশন— ঘুম। কোনও রকমে দুপুরে সেই হোটেলে খেয়ে আসা হল। ফিরে এসে আবার ঘুম। বিকেল হল, সন্ধে হল। উঠলেও বেরোনোর নাম নেই। বেড়াতে এসেছি। ঘরে বসেই কাটিয়ে দেব? এসব বলেও কোনও লাভ হল না। কেউ পাত্তাই দিল না। ওদের দাবি, তুই বেড়াতে এসেছিস, বেড়িয়ে আয়। আমরা এসেছি ভূত দেখতে, আমরা রাতে বেরোবো।
এ তো আজব পাবলিকদের পাল্লায় পড়া গেল। আমি তখন ভয়ঙ্করভাবে সংখ্যালঘু। ১:৫। অগত্যা, গণতন্ত্রের রায় শিরোধার্য। কুন্তলদা তখন নানারকম গল্প ফেঁদে চলেছে। কিছুটা সত্যি, কিছুটা জল মেশানো। কিন্তু এমন নিপুন সেই বলার কায়দা, কোনটা দুধ, কোনটা জল ফারাক করা হাঁস তো দূরের কথা, স্বয়ং পরমহংসেরও অসাধ্য। সঙ্গ দিয়ে চলেছে জয়, কুণালরা। সানি বলে একজন গিয়েছিল। সে উঠতি ব্যান্ড গায়ক। তাই মাঝে মাঝেই গানের কথাও উঠে আসছিল। আমার খালি মনে হচ্ছিল, এরা বেড়াতে এসে ঘুমিয়ে আর ঘরে বসেই কাটিয়ে দেবে?
রাতে হোটেল তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কেয়ারটেকার বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে আসতে। কিন্তু তখন চলছে নৈশ অভিযানের প্রস্তুতি। জোগাড় করা হল হ্যাজাক লাইট। কয়েকটা টর্চ তো সঙ্গেই ছিল। হ্যাজাক, টর্চ, লাঠি নিয়ে নৈশ অভিযান। হোটেলে খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়া। যেন ভূতেদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে। তারা যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাস্তা শুনশান। টেলিফোন বুথ নেই, ইলেকট্রিকের তার কাটা। শোনা গেল, এদিকে মাওবাদীদের উপদ্রব। তারাই তার–ফার কেটে গেছে। এই অবস্থায় লাঠি, হ্যাজাক হাতে আমরা ছজন রাতের বেলায় ঘুরছি। এ যেন উভয় সংকট। মাওবাদীরা ভাবতে পারে, পুলিশের লোক। আর পুলিশ বা গ্রামবাসী ভাবতে পারে, ব্যাটারা নির্ঘাত উঠতি মাওবাদী। রাতে দেশি মুরগির ঝোল খাওয়ার পর গণপিটুনি জুটতেই পারে।
লোকালয় থেকে আরও ফাঁকার দিকে। একটার পর একটা পোড়ো বাড়ি। কতকাল রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। দরজায় লতা পাতা ঝুলছে। হাওয়ার শব্দ। দেওয়ালের সঙ্গে গাছের ডাল ঘসা যাচ্ছে। রোমাঞ্চকর এক পরিবেশ। ওদের কাছে সেটা যেন ভূতের পদধ্বনি। একটু একটু করে এগোলাম জঙ্গলের দিকে। মনে মনে বলছিলাম, সারাদিন শুয়ে বসে কাটালাম, রাতে কিনা বেরোলাম ভূত দেখতে! দূরে রাস্তায় লোক পেরোচ্ছে। তাকেই বেমালুম ভূত বলে চালিয়ে দেওয়া। আর এটা–ওটা আওয়াজ উঠলে তো কথাই নেই। সব ভূতের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দাও। এভাবেই রাত এগারোটা পেরিয়ে গেল। সব বিদ্রোহী যেন রণক্লান্ত। চলো মন নিজ নিকেতনে। সবাই সেই বাড়িতে ফিরে এলাম।
বিকেল আর সন্ধেটা ছিল কুন্তলদার। কিন্তু রাতে সানিকে যে নিজের প্রতিভা মেলে ধরতেই হবে। শুরু হল ব্যান্ডের গান। গান না বলে গানের গুঁতো বলাই ভাল। কী কথা, কী সুর, কোনওকিছুর মাথামুণ্ড কিছুই বুঝিনি। তবু বলে যেতে হল, দারুণ হচ্ছে। একেবারেই অন্য ঘরানার গান। আর দ্বিগুন উৎসাহ পেয়ে সানিও বিকট চিৎকার (ওর ভাষায় গান) করেই চলেছে। অগত্যাই রাতটা গড়িয়ে গেল ভোরের দিকে। ভোর রাতে ঘুম। কখন ভাঙবে, কে জানে!
পরদিন ঘুম ভাঙল বেশ বেলার দিকে। কী আর ব্রেকফাস্ট করব। এ তো লাঞ্চটাইম। সেই হোটেল। ভাত দিয়েই ব্রেকফাস্ট। দুদিন হতে চলল। লাট্টু পাহাড়, রাজবাড়ি, ফলস কিছুই তো দেখা হল না। অগত্যা খাওয়ার পর একটা অটো রিজার্ভ করা হল। অটো–দাদাকে বলা হল, দু তিন ঘণ্টার মধ্যে যা যা ঘোরানোর ঘুরিয়ে দিতে। সে তো আপন মনে ইতিহাস বিকৃতি করে গেল। যে বাড়িটাই দেখছে, সেটাই নাকি বর্ধমান রাজার বাড়ি। রাজার কী দুর্দশা! পোড়ো বাড়িগুলোও তার নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই শিমূলতলায় নাকি দাদার কীর্তির শুটিং হয়েছে। কোন বাড়িতে? বুঝলাম, সে নিজেও জানে না। লাট্টু পাহাড়, ধারারা ফলস দেখা হল। পাথরের ওপর জল গড়িয়ে পড়ছে। এটাই নাকি ফলস। আর লাট্টু পাহাড়কে পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভাল। সন্ধের আগেই ফিরে আসা। আবার একপ্রস্থ ঘুম। রাতে সেই হোটেল। খাওয়া সেরে হ্যাজাক–টর্চ–লাঠি সহযোগে ফের ভূত–অভিযান। যথারীতি রাত এগারোটা পর্যন্ত ‘ভূতের সন্ধানে’। ফিরে এসে সানির গান–গুঁতো।
পরদিন ফেরার পালা। তার আগে হোটেলের ধার মিটিয়ে আসতে হবে। বিল শুনে মাথায় হাত। দুদিন চারবেলা ছজনের খাওয়া। তার মানে ২৪ টা মিল। কত হতে পারে? দোকানি যে দর হাঁকল, পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁগুলিও লজ্জা পেয়ে যেত। আন্দাজে বিশাল দর হেঁকে ফেলেছে। কিন্তু কোনটার জন্য কত, বলতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলছে। শুনলাম, আমাদের জন্য নাকি সাতশো টাকার চাল লেগেছে। ষোল বছর আগের কথা। তখন চালের কেজি বড়জোর দশ টাকা। তার মানে, আমরা দুদিনে সত্তর কেজি চালের ভাত খেয়েছি! ডুয়ার্সের হাতিগুলোও বোধ হয় পরিসংখ্যান শুনলে লজ্জা পেত। সে যাই হোক, বোঝা গেল, মোট বিলে একটা শূন্য বেশি পড়ে গেছে। তাই দশগুণ হয়ে গেছে। সেসব খুচরো ঝামেলা মিটিয়ে আবার কু ঝিক ঝিক। যাওয়ার সময় যেসব প্রশ্নগুলো ঘোরাফেরা করছিল, ফেরার সময় আবছা আবছা উত্তর পেয়েছি। কাদের বাড়ি, কারা আসত, এখন কেন বাড়িগুলোর এমন জীর্ণ দশা, উত্তরগুলো কিছুটা পরিষ্কার। কিন্তু বাকি পাঁচজনের এসব নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। তাঁদের আক্ষেপ, ভূত দেখা হল না। আমার অবশ্য ‘ভূত প্রীতি’ বা ‘ভূত ভীতি’ তখনও ছিল না। আজও নেই। কিন্তু সেই নৈশ অভিযানের একটা রোমাঞ্চ তো আছেই। যা এতদিন পরেও মনকে ছুঁয়ে যায়।