[একটি একাঙ্ক নাটক]
(ঠিক তিন বছর আগে। বেঙ্গল টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল দুরন্ত এক রম্য রচনা। আদি তুঘলক বনাম নব তুঘলক। তখনকার প্রেক্ষাপটে লেখা। পাঠক মহলে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। তিন বছর পরেও প্রেক্ষাপট কিছুটা একই রকম। পাঠকের দাবিতে সেই দুরন্ত লেখাটি বেঙ্গল টাইমসে আবার ফিরিয়ে আনা হল। যাঁরা পড়েননি, দ্রুত পড়ে ফেলুন। যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা আবার পড়ুন। )
স্থানঃ পশ্চিমবঙ্গ
কালঃ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ
চরিত্রঃ মহম্মদ বিন তুঘলক
রবি কর
(সারা জীবন সাংবাদিকতা করে করে রবি করের মনোবিকার দেখা দিয়েছে। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে, শয়নে-স্বপনে, তিনি কেবলই খবর খোঁজেন। মানুষ দেখলেই সাক্ষাৎকার নিতে ছুটে যান। জীবিত মানুষরা তাঁর প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে যাওয়ায় একদিন ভোররাতে তিনি মহম্মদ বিন তুঘলককে প্লানচেট করে ডেকে পাঠালেন। তারপর…)
রবি করঃ বন্দেগি জাহাঁপনা। আমাদের পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হওয়ার জন্য অনেক অনেক সুক্রিয়া। বেঙ্গল টাইমসের পক্ষ থেকে আপনাকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
মহম্মদ বিন তুঘলকঃ আরে থাক থাক অত বিনয় করতে হবে না। আর শোন আমাকে জাহাঁপনা বলে ডাকতে হবে না, ইতিহাসে লাখে লাখে জাহাঁপনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার বদলে অন্য এসে গেলে ইন্টারভিউ মাটি হবে।
রবিঃ তাহলে আপনাকে কী বলে ডাকব জাহাঁপনা?
তুঘলকঃ আবার বলে জাহাঁপনা। শোন আমাকে তুঘলকদা বলেই ডাকবি। তোরা সাংবাদিকরা তো পারলে নিজের বাপকেও দাদা বলিস।
রবিঃ হেঁ হেঁ তা কি হয়? আপনি হলেন গিয়ে জাহাঁ.. থুড়ি সুলতান। তাছাড়া ইতিহাসে তো আরও কয়েকজন তুঘলক আছেন। গুলিয়ে যাবে না?
তুঘলকঃ আরে দুর। তুঘলক নাম হলেই আমার মতো তুঘলক হওয়া যায় না কি? এই যে তোরা কথায় কথায় বলিস দেশে তুঘলকি কারবার চলছে, সেটা কি ফিরোজ শা তুঘলক? ক্লাস ফাইভের বাচ্চাকে জিগ্যেস কর, সেও বলে দেবে তুঘলক বলতে কাকে বোঝায়।
রবিঃ সত্যি তুঘলকবাবু ইতিহাসে আপনি অতুল কীর্তি রেখে গেছেন। কিন্তু জাহাঁ.. মানে ইয়ে.. মানে যাই হোক, আজকাল আপনার কীর্তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। লোকে বলছে বঙ্গাল মুলুকে আপনার এক প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়েছে।
তুঘলকঃ কী? আমার প্রতিদ্বন্দ্বী? আমার আব্বা হুজুর বঙ্গাল মুলুকে বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। এখন দেখছি আমাকেও ওখানে যেতে হবে।
রবিঃ ওই রকম প্রতিদ্বন্দ্বী নয় সাহেব, কাজে কর্মে প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি শপথ করেছেন, আপনার সব কীর্তিকে ছাপিয়ে যাবেন।
তুঘলকঃ কী রকম?
রবিঃ এই ধরুন, আপনার আব্বা হুজুর বঙ্গাল মুলুকে বিদ্রোহ দমন করে ফেরার পথে আপনি তাঁকে গুপ্তহত্যা করিয়েছিলেন, উনিও কাজ গুছিয়ে নেওয়ার পর বলছেন, কে কিষেনজি ? বলে — ।
তুঘলকঃ আঃ! তোকে কে বলল আমি গুপ্তহত্যা করিয়েছিলাম। ও সব সাজানো ঘটনা, পেইড নিউজ।
রবিঃ দেখলেন কেমন মিল। ইনিও তাই বলেন। যাই হোক, আপনি তো রাজধানী স্থানান্তর করতে গিয়েও বছর খানেক পরে পিছিয়ে এলেন। ইনিও রাজধানী সরিয়ে গঙ্গার ওপারে নিয়ে গেছেন। বলেছেন, কদিন পরে আবার ফিরে আসবেন।
তুঘলকঃ অ্যাঁ! রাজধানী নিয়ে নাড়াচাড়া করছে? বলিস কি! আমি তো ভেবেছিলাম, খোদার কারখানায় আমার মতো প্রোডাক্ট একপিস-ই তৈরি হয়েছে।
রবিঃ আরও আছে স্যার। আচ্ছা আপনিই বলুন। আপনি জীবনে কতগুলো জিনিসের নাম বদল করেছেন?
তুঘলকঃ নামবদল? তা তো ওই একটাই। দেবগিরির নাম বদলে রেখেছিলাম দৌলতাবাদ। তবে নামকরণ কিছু করেছিলাম। যেমন, জাহানপনা নামে একটা শহর, আদিলাবাদ নামে একটা দুর্গ।
রবিঃ আমাদের তুঘলক এব্যাপারে আপনাকে ৫ গোল দেবেন। উনি হাতের কাছে যা পান তারই নামকরণ করেন। তাঁর রাজসভার নাম নবান্ন, মোমের মিউজিয়ামের নাম মাদার…
তুঘলকঃ রাজসভার নাম নবান্ন! বলিস কী! হা-হা-হা এরপর ত বলবি ছাতার নাম বৈজয়ন্ত, বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমুঢ়।
রবিঃ আরে আপনি তো হযবরল-র ন্যাড়ার ডায়লগ দিচ্ছেন! আপনি সুকুমার রায় জানেন?
তুঘলকঃ জানি মানে! লোকে আমাকে কী বলতো জানিস? চলমান বিশ্বকোষ। সাহিত্য, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, অর্থনীতিতে আমার অগাধ জ্ঞান।
রবিঃ আমাদের তুঘলকও খুব জ্ঞানী। আপনি যদি M.B.T. স্যার হন, উনি তাহলে M.B. ম্যাডাম। আপনি এতো অর্থনীতি পড়েও তামার মুদ্রা চালু করতে পারলেন না। আর উনি কিছু না পড়েই বলে দিলেন, ধুপকাঠি বেচা, বড়ি দেওয়া, আচার বানানো এ সব শিল্প। নাচগানও শিল্প। উৎসব, মেলা এসব করলেও কর্মসংস্থান হয়। ভাবুন কত জ্ঞান।
তুঘলকঃ হুম অর্থনীতিতে ইনি সত্যিই আমার সমকক্ষ। তা জ্যোতির্বিজ্ঞান মানে গ্রহ তারা নিয়ে উনি কিছু জানেন?
রবিঃ জানেন না আবার! ওঁর চারদিকে তারকার ছড়াছড়ি। তারকার বিষয়ে উনি জানবেন না তো কে জানবে? কত তারকা- চিত্রতারকা, নাট্যতারকা, কাক তারকা, গান তারকা, কাব্যতারকা, সাংবাদিক তারকা। কেউ চ্যানেল বেচে টাকা মারে, কেউ চেয়ার মোছে, কেউ এক ফোনে এক লাখ দেয়, কেউ লোক পাঠিয়ে রেপ করায়, কেউ বলে, আমি বলছি বোম মারুন।
তুঘলকঃ হ্যাঁ রে কিছু বলে না? জানিস, একবার কাজির দরবারে আমার বিচার হয়েছিল। কাজি আমাকে বেত মারার শাস্তি দিয়েছিলেন। তখন আমি সুলতান। কিন্তু কাজির উপর রাগ করিনি। বরং বলেছিলাম, কাজি তুমি যদি আমাকে শাস্তি না দিতে, তাহলে আমিই তোমাকে বেত মারতাম।
রবিঃ উনি আপনার মতো সহিংস নন। উনি অহিংসার পূজারি। উনি বলেছেন, ছোট ছোট ছেলেরা এমন করতেই পারে। তাছাড়া টাকা দিয়ে বিচার কেনা যায়। তবে সত্যিকারের অপরাধী মানে সি পি এম, মাওবাদী এদের উনি দেখেই চিনতে পারেন। তখন উনি রাফ অ্যান্ড টাফ।
তুঘলকঃ আমার গুরু নিজামুদ্দিন আউলিয়া মানুষ দেখে চিনতে পারতেন। কিন্তু তাঁরও এতো প্রতিভা ছিল না।
রবিঃ নিজামুদ্দিন? উনি কি ইমাম? তা হলে তো ভাতা পাবেন।
তুঘলকঃ কী? ভাত পাবেন? কে ভাত দেবে? সত্যিকারের সাধক কখনও শাসকের ভাত খায়? আমার আব্বা আউলিয়াকে দলে টানার কত চেষ্টা করেছিল, পেরেছিল?
রবিঃ উনি না পারলেও ইনি পারেন। দলে দলে লোক অন্য দল থেকে এঁর দলে আসেন। বুদ্ধিজীবী, KGB, 2 GB, 8 GB সবাই।
তুঘলকঃ যাক গে! যাক গে! নামকরণের কথা কী বলছিলিস বল।
রবিঃ আমাদের তুঘলকের ট্রেনের নাম মাতৃভূমি, স্টেশনের নাম গীতাঞ্জলি, বইয়ের নাম নন্দীমা, জলের ট্যাঁঙ্কির নাম রামকৃষ্ণ, রাস্তার নাম বিশ্ববাংলা,
তুঘলকঃ দাঁড়া দাঁড়া রাস্তার নাম বিশ্ববাংলা ? এর মানে কী? বিশ্বের লোক যেখানে বাংলা খায়। সমাস কী? ব্যাসবাক্য কী?
রবিঃ জানি না হুজুর। তবে রাস্তাটার নাম আগে ছিল ই এম বাইপাস। উনি পালটে দিলেন। এই রাস্তার পাশেই ছিল জ্যোতি বসু জল শোধনাগার। উনি নাম পাল্টে করে দিলেন জয় হিন্দ। পরমা আইল্যান্ডের মূর্তি ভেঙে বিশ্ব বাংলার লোগো বসিয়ে দিলেন। মৌলালি যুবকেন্দ্রের মুরাল মুছে নতুন নকসা করলেন। লোকে দেখে ভাববে এসব ওঁরই তৈরি।
ম বি তুঃ অন্যের জিনিস নিজের বলে চালানো! এই বদভ্যাস ছিল আলাউদ্দিন খিলজির। উনি কুতুব মিনারের গায়ে একটা ফলক লাগিয়ে দাবি করেছিলেন, এটা ওঁরই তৈরি। তারপর ওখানেই একটা মাদ্রাসা খুলেছিলেন।
রবিঃ আমাদের তুঘলকও মাদ্রাসা খোলায় উৎসাহ দেয়। বেআইনি মাদ্রাসা। ধু ধু মাঠের মধ্যেখানে। তারপর খাগড়াগড়, ইমরান, সিমি, ইডি,এন আই এ।
তুঘলকঃ কী যে বলছিস, কিছু বুঝতে পারছি না। যা বলছিলিস বল, শহরের আর কী কী পাল্টালো?
রবিঃ শহরের রঙটাই তো পাল্টে দিল। দেখে মনে হবে পুরো ব্লু ফিল্ম। তারপর বসালো ত্রিফলা।
তুঘলকঃ ত্রিফলা! মানে বাসক, তুলসী, যষ্টিমধু?
রবিঃ ধুর মশাই —-। থুড়ি, গুস্তাখি মাফ। এ হল ত্রিফলা বাতি। পুরনো বাতির বদলে নতুন বাতি বসছে। নতুন রেলিং, নতুন ফুটপাথ।
তুঘলাকঃ হ্যাঁ রে, এত যে হচ্ছে, টাকা আসছে কোত্থেকে ?
রবিঃ রাজকোষ থেকে। আপনার যেমন আসত।
তুঘলকঃ আমি তো রাজকোষ ভরানোর জন্য দোয়াব অঞ্চলে নতুন কর বসিয়েছিলাম। তার জন্য আমার কত বদনাম। আমি নাকি অত্যাচারী।
রবিঃ এঁর নামে বদনাম দিতে পারবেন না। ইনি কর বসান না। উল্টে অক্লান্ত মোহতার মতো পেয়ারের লোক বা বাড়িতে যারা নীল সাদা রঙ করে, তাদের কর ছাড় দেন। রাজকোষ ভরানোর জন্য ইনি ছবি আঁকেন। সে যা ছবি না! শুভাদা বলেছে, পুরো ভ্যান গঘ।
তুঘলকঃ ছবি আঁকে? আর কী কী করে ? আগুন লাগলে বেহালা বাজায় ?
রবিঃ বেহালা নয়, গিটার গিটার। বৃন্দনীল সেনের কাছে ইনি গিটার শেখেন। এর পাশাপাশি কবিতাও লেখেন। বুঝলেন ? বাংলা, ইংরাজি দুটো ভাষাতেই।
তুঘলকঃ কবিতা ? বাহ। কবিতা শুনতে আমি খুব ভালবাসি। শুনি, একটা শুনি।
রবিঃ ওনার অনেক কবিতা আমার মুখস্থই থাকে। স্মৃতি থেকেই বলছি। শুনুন তাহলে —
তোমার নাম? হ্যালো হাই
বাবার নাম? সি ইউ বাই
মায়ের নাম? হাই ফাই
বোনের নাম? সুইটি পাই।
যাচ্ছো কোথায় ? ফেস্ট করতে।
ফিরবে কখন? ঘুমঘুমোতে।
খাবার মেনু? চিপস ঠান্ডাতে।
শরীর কেমন? একেবারে স্লিম,
শরীর চর্চা করো, আছে তো জিম।
এতো রোগা ? ওটাই তো ড্রিম।
অসুখ করলে ? আছে মেডিক্লেম।
তুঘলকঃ (উঠে দাঁড়িয়ে হেঁচকি তুলতে তুলতে) ওরে কেউ আমাকে এক গ্লাস জল দে রে। ও রে কে আছিস, জিয়াউদ্দিন বরনী —।
রবিঃ দ্বিধা হও ধরনী। সুলতান আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে ? উনি কিন্তু ডাক্তারিটাও জানেন।
তুঘলকঃ (চোখ লাল করে খাবি খেতে খেতে) ওরে, জিয়াউদ্দিন বরনীকে ডাক। সে তো আমাকে পাগল বলেছিল। আমি জানতে চাই, আমি পাগল হলে এটা কী ?
রবিঃ কবি, জাঁহাপনা। কবি, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞা, চলচ্চিত্রবোদ্ধা, ধর্মানুরাগিনী, ক্রীড়ামোদি, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা –।
তুঘলকঃ চুপ, একদম চুপ। কবি ? এর নাম কবিতা ? হারামজাদা। এই কবিতা শোনানোর জন্য তুমি আমাকে প্ল্যানচেট করে ডেকে এনেছো ? জুতিয়ে আজ তোমার ছাল ছাড়াবো।
এ কী আমার পায়ে হাওয়াই চটি কেন ? নাগরা জুতো কোখায় গেল ?
রবিঃ পরিবর্তন পরিবর্তন। নব তুঘলকের হাওয়াই চটি আদি তুঘলকের পায়ে ফিট করে গেছে (বিস্ময়ে ও আতঙ্কে রবি করের পতন ও মুর্ছা)
তুঘলকঃ (হাওয়াই চটি হাতে নিয়ে মঞ্চে তান্ডব নৃত্য করতে করতে) পাগল! আমি একা পাগল! শীগগিরি ইতিহাসের সিলেবাস পাল্টা। এমন যন্তরকে বাদ দিয়ে কোন উজবুক আমাকে পাগল বলিস? সামনে আয়।
(নেপথ্যে গানঃ লে পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স। আলো নিভে আসে। যবনিকা পতন। )
(সব চরিত্র কাল্পনিক ? ভাবতেও পারেন। নাও ভাবতে পারেন।এই নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য নাট্যকার বা বেঙ্গল টাইমসের কোনও লিখিত বা মৌখিক অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।নিজের দায়িত্বে মঞ্চস্থ করুন। প্যাঁদানি খেলে, সেটাও নিজের দায়িত্বে খান। )