জন্মদিবসে জীবনসঙ্গীতে মান্না দে

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

২০০৮ সালের ২৫শে ডিসেম্বরের সকাল। রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। দর্শকাসনে বসে আমি। হলের বাইরেও বহু সঙ্গীতপ্রেমী জনতার ভিড়। প্রথমে কিছুক্ষণ ডঃ শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করলেন। তারপর ১১টা বাজতেই সঞ্চালকের ঘোষণা “এবারে সঙ্গীত পরিবেশন করতে আসবেন তিনি”। সারা হল যেন ফেটে পড়ল হাততালিতে। হলের ডানদিকের গ্রীনরুম থেকে সেই সময়ের নব্বই ছুঁই ছুঁই এক বৃদ্ধ স্টেজে এসে পৌঁছতেই সমবেত সঙ্গীতপ্রেমী জনতা নিজ নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বরণ করে নিলেন বাঙালির প্রাণের শিল্পী মান্না দে কে । আজ সেই ১লা মে। প্রবাদপ্রতিম শিল্পী মান্না দের ৯৯ তম জন্মদিন।

manna dey6
আসলে মান্না দে এমনই একজন শিল্পী, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় ৮ থেকে ৮০, প্রতিটি বয়সের শ্রোতার মনেই বিশিষ্ট আসন অধিকার করে নিয়েছিলেন। বাঙালি তো বটেই, সারা ভারতব্যাপীই তাঁর আকাশছোঁয়া খ্যাতি। আর যেহেতু তিনি বাংলা, হিন্দি ছাড়াও আরও প্রায় ১৫ টি ভাষাতে গান রেকর্ড করেছিলেন, তাই তাঁর নামযশ সারা ভারতেই সমুজ্জ্বল। সর্বোপরি গানের প্রতি তাঁর নিরলস সাধনা ও সুনিবিড় ভালোবাসাই তাঁর নব্বই ঊর্দ্ধ বয়সেও গান রেকর্ড করা থেকে শুরু করে পাবলিক ফাংশন করার মানসিক শক্তির মূল উৎস। অথচ কিংবদন্তী এই শিল্পীর সঙ্গীত জীবনের প্রথমভাগ মোটেই তেমন উজ্জ্বল ছিল না। বাড়িতে তাঁর কাকা ও ভারতবিখ্যাত গায়ক সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে–‌ই তাঁর গানের প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসার মূল প্রেরণা। কাকার কাছেই প্রথমে তরল সঙ্গীত থেকে ক্রমে উচ্চাঙ্গ ও শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া। তরুণ মান্না দের রক্তে তখন সঙ্গীতের নেশা। সেখান থেকেই বি.কম গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরে সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগে সঙ্গীতকে নিজের পেশা করে পরিবারের অমতে কাকার সাথে মুম্বই-(তদানীন্তন বম্বে) তে পাড়ি দেওয়া। সেটা ১৯৪৩ সাল। প্রথম গান রেকর্ড করলেন “রামরাজ্য” নামের একটি হিন্দি ছবিতে। তারপর টানা সাত বছর আরও অনেক হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক করলেও সেই সব গান সেভাবে হিট করেনি। মান্না দে বহুবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন পরে যে মুম্বই পাড়ি দেওয়ার পরে বলিউডে যেসব হিন্দি সিনেমা তে তিনি প্রথমে প্লে ব্যাক করেছিলেন তাতে তার নিজেরই satisfaction হত না। হয় সে সব গান নায়কের মুখে থাকতো না, অথবা সিনেমা থেকেই বাদ পড়তো পরিচালক ও প্রযোজকের নির্দেশে। সে সময় মান্না দে প্লেব্যাক ছাড়াও তাঁর কাকার সহকারী হিসেবে বা তাঁর কাকার সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র শচীনদেব বর্মণের সহকারী হিসেবেই বিভিন্ন ছবিতে কাজ করতেন। অবশেষে ১৯৫০ সালে এই শচীনদেব বর্মণের সুরেই “মশাল” ছবিতে মান্নাদের বলিউডে প্রথম হিট গান “উপর গগন বিশাল”। গানটি শুধু হিটই ছিল না, , এই গান মান্না দে কে মুম্বই ফিল্মই ন্ডাস্ট্রিতে একরকম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলই বলা চলে। তাছাড়া এই গান গেয়ে মান্না দে তদানীন্তন বলিউডের প্রায় সব নামজাদা সঙ্গীত পরিচালকদের সুনজরে পড়ে গেলেন। এর ফল স্বরূপ পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৫১ সালে রাজ কাপুরের ছবি “আওয়ারা” তে শঙ্কর জয়কিশনের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েট গান “তেরে বিনা আগ ইয়ে চাঁদনি ” রেকর্ড করলেন। তারপরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সলিল চৌধুরির সুরে “দো বিঘা জমিন“ , “পরিনীতা”, কিংবদন্তী সুরকার নৌশাদ এর সুরে “শবাব”, “মাদার ইণ্ডিয়া”, শচীন দেববর্মণের সুরে “মনজিল”,” মেরি সুরত তেরিআঁখে”,”বাত একরাত কি”,”তালাশ”, রোশন এর সুরে “দিল হি তো হ্যায়” ছবিতে রাজ় কাপুরের লিপে গাওয়া বিখ্যাত গান “লাগা চুনরী মে দাগ”, শঙ্কর জয়কিশনের সুরে রাজ কাপুরেরই লিপে “শ্রী৪২০” ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সাথে ডুয়েট গাওয়া চিরদিনের সেরা রোমান্টিক গান “প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া” বা “চোরী চোরী”ছবিতে “আজাসনম”,’ইয়ে রাত ভিগি ভিগি”—– সবকটি গানেই মান্না দে তার অনবদ্য সাঙ্গীতিক দক্ষতার জ্বলন্ত নিদর্শন রেখেছেন। বলিউডে সেই সময় মহম্মদ রফির একচেটিয়া আধিপত্যের দিনেও যেখানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রয়োজন হত, সুরকারদের কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দ ছিল মান্না দে। বা পরে বলিউডে কিশোর কুমারের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার দিনেও কিন্তু মান্না দে তাঁর স্বাতন্ত্র্যে ও উৎকর্ষতায় সমুজ্জ্বল ছিলেন। রাজ কাপুর থেকে দেব আনন্দ,বলরাজ সাহানি থেকে শাম্মি কাপুর বা একটু পরের দিকে যারা নায়কের ভুমিকায় প্রধান ছিলেন সেই রাজেশ খান্না,শশী কাপুর থেকে অমিতাভ বচ্চন—প্রায় সবার লিপেই মান্না দের একাধিক হিট গানের উদাহরণ রয়েছে। তা ছাড়া মান্না দের একটি বিশেষ দক্ষতা ছিল ছায়াছবির কৌতুকগীতি বা কমেডি সং গায়নের। বলিউডের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতা মেহমুদ সাহেব লিপ দেওয়ার জন্য মান্না দে কেই চয়ন করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ “মঞ্জিল” ,”জিদ্দী”,”ভূত বাংলো”,”বিবি আউর মকান”,”লাভ ইন টোকিয়ো”,‘‌পড়োসন’‌,”প্রীতম”, ”সুহাগ রাত”,‘‌‘‌দাদি মা”—ইত্যাদি প্রায় ৩০ টি ছবিতে মান্না দেই ছিলেন মেহমুদের নেপথ্যে প্রধান গায়ক। মেহমুদ ছাড়াও জনি ওয়াকার, মুকরি, প্রেমনাথ প্রমুখ কৌতুকাভিনেতার লিপেও মান্না দে অজস্র গান রেকর্ড করেন। শচীন দেব বর্মণ, নৌশাদ, ও.পি.নায়ার,সলিল চৌধুরি, রাহুল দেব বর্মণ, জয়দেব, মদন মোহন, শঙ্কর ও জয়কিশান, লক্ষ্মীকান্ত পিয়ারিলাল, হেমন্ত কুমার-(হেমন্ত মখোপাধ্যায়), বসন্ত দেশাই, রবি,‌ বাপি লাহিড়ী—প্রায় সব যশস্বী ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গেই মান্না দে কাজ করেছিলেন। আর বলিউডের হিন্দি ছবিতে রোমান্টিক থেকে ডুয়েট, ক্ল্যাসিকাল থেকে গজল,প্যাট্রিয়োটিক থেকে ডিভোশনাল, কাওয়ালি থেকে কমেডি, গজল থেকে ঠুংরি— প্রায় সব ধরণের গান রেকর্ড করেই তিনি তাঁর অনন্য সাঙ্গীতিক প্রতিভার উজ্জ্বল সাক্ষর রেখে গিয়েছেন।

manna dey8
এই তো গেল হিন্দি গানের সুদীর্ঘ ৫০ বছরের ইতিহাস। আর মাতৃভাষার গানে মান্না দের আগমন কিন্তু সেই অর্থে একটু পরে। সেইসময় বাংল ছবির জগতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একচেটিয়া আধিপত্য। উত্তম কুমারের লিপে গান মানেই সুরকার, প্রযোজক, পরিচালক তথা মহানায়কের প্রথম পছন্দ সেই জলদমন্দ্র রোমান্টিক কণ্ঠের অধিকারী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কাজেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতেও মান্না দে র বিশিষ্ট আসন অধিকার করাটা বেশ একটু কঠিনই ছিল। সর্বপ্রথম বিশিষ্ট সুরকার সুধীন দাশগুপ্তই মান্না দে কে উত্তম কুমারের লিপে গান পাওয়ান। সেটা ১৯৬৫ সাল। “শঙ্খবেলা” ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মান্না দে প্রথম গাইলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম সেরা রোমান্টিক গান “কে প্রথম কাছে এসেছি”। এ ছাড়াও এই ছবিতে একটি ভিন্নস্বাদের কমেডি সং ছিলো উত্তমকুমারের লিপে,‘‌আমি আগন্তুক’‌। এই দুটি গান গেয়েই মান্না দে উত্তমকুমারের লিপে গান গাওয়ার জায়গা একপ্রকার পাকা করে নিলেন বলা চলে। তারপরে “এন্টনি ফিরিঙ্গি”, চিরদিনের ”,”জীবনমৃত্যু”,”চৌরঙ্গী”,”ছদ্মবেশী”,”স্ত্রী”, “সন্ন্যাসী রাজা”,”মৌচাক”,”আলো আমার আলো”,রাতের রজনীগন্ধা”,”হার মানা হার”, সেই চোখ”, “ভোলা ময়রা”, “ব্রজবুলি” ইত্যাদি প্রায় ২৪ টি ছায়াছবিতে উত্তমকুমারের লিপে গান করেন মান্না দে। সেখানে যেমন রোমান্টিক সং ও রয়েছে, তেমনি “ছদ্মবেশী” ছবিতে “আমি কোন পথে যে চলি” র মতো কৌতুকগীতি বা “সন্ন্যাসী রাজা” তে “ভালোবাসার আগুন জ্বালাও” এর মতো রাগাশ্রয়ী গান ও রয়েছে। মহানায়ক ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপেও মান্না দে অনেক গান করেছিলেন। তার মধ্যে “তিন ভুবনের পারে” ছবিতে “জীবনে কি পাবো না” সুধীন দাসগুপ্তের সুরে একটি অনন্য স্বাদের গান। এ ছাড়াও এই ছবিতেই গাওয়া রোমান্টিক গান “হয়তো তোমারি জন্য” বাঙালির প্রেমিক মননে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে । “বসন্ত বিলাপ’,”সুদূর নীহারিকা”, “নতুন দিনের আলো”, “অসতী”, “প্রথম কদম ফুল”, “বাবুমশাই”,”অগ্রদানী” ইত্যাদি ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে গান করেন মান্না দে। এর মধ্যে সব কটি গান বাণিজ্যিক ভাবে হয়তো সফল হয়নি। কিন্তু প্রতিটি গানেই মান্না দে তাঁর আশ্চর্য গায়ন দক্ষতায় ছবির সিচুয়েশন অনু্যায়ী সেই ছায়াছবির কাহিনীর সেই চরিত্রের মুখে একেবারে মানানসই ছিলেন। এছাড়াও অনিল চট্টোপাধায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়,অনুপকুমার, রবি ঘোষ, উৎপল দত্ত, রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে, সমিত ভঞ্জ প্রমুখের মুখে বহু গান করেন মান্না দে। হিন্দির মতো বাংলা ছবিতেও কমেডি গান থাকলেই সঙ্গীত পরিচালক দের প্রধান পছন্দ ছিল মান্না দে। গানের সিচুয়েশন অনুযায়ী অ্যাকটিং করে আশ্চর্য গায়ন ভঙ্গিতে ও উচ্চারণে যে সব গান করেছিলেন মান্না দে তা সত্যিই একজন ভার্সেটাইল সিঙ্গার এর সঙ্গীত সাধনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর মধ্যে “বসন্ত বিলাপ” ছবিতে “লেগেছে , লেগেছে আগুন”, “প্রথম কদম ফুল” ছবিতে “আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না”,”একদিন রাত্রে” ছবিতে “এই দুনিয়ার ভাই সবই হয়”, “অদ্বিতীয়া” ছবিতে “এই মাল নিয়ে চিরকাল”,”কবিতা” ছবিতে “আমি তো কুমীর ধরে আনিনি” ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখ্য। বাংলা ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত,সলিল চৌধুরি, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, গোপেন মল্লিক, রাজেন সরকার, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় দাস—প্রায় সব বরেণ্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকের সুরেই গান করেছেন মান্না দে। তা ছাড়া বাংলা বেসিক গান মান্না দে কে বাঙালীর মনের মণিকোঠায় অক্ষয় আসন দান করেছে। “তীর ভাঙা ঢেউ”,”এই কুলে আমি”,আমি সাগরের বেলা”, “চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে”,”দরদী গো কি চেয়েছি আর কি যে পেলাম”,”ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে”, “ সবাই তো সুখী হতে চায়”, “ কথায় কথায় যে রাত”, “আবার হবে তো দেখা”,”আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে”, “যদি কাগজে লেখো নাম”,”ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে”,”কে তুমি তন্দ্রাহরণী”,”রিমঝিমঝিম বৃষ্টি”, ”দীপ ছিলো শিখা ছিলো,”আমি নিরালায় বসে”,”কথা দাও আবার আসবে”,”সুন্দরী গো দোহাই দোহাই,কফি হাউসের সেই আড্ডাটা”—ইত্যাদি অজস্র গান সঙ্গীতপ্রেমী বাঙালির মনন-চিন্তনে মিশে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। প্রতিটি গানই নিজ নিজ সুরের স্বাতন্ত্র্যে অনন্য সাধারণ। আর তাতে এক উজ্জ্বল-ভাস্বর জ্যোতিরূপ দান করেছেন মান্না দে তাঁর নিরলস সঙ্গীত সাধনার যথার্থ প্রয়োগগুণে। সুরকার হিসেবে তিনি হয়তো বাংলা ছায়াছবিতে ততটা সমুজ্জ্বল হতে পারেননি। ৬ টি বাংলা ছবিতে সুরারোপ করেছিলেন। “রাম ধাক্কা”, “শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন”, বাবুমশাই”,প্রেয়সী”, “ললিতা” ও “কত ভালোবাসা”। ছবিগুলির গান বাণিজ্যিক ভাবে লাভের মুখ না দেখলেও সেগুলি সঙ্গীত রসিক শ্রোতাদের বারবার মুগ্ধ করেছে। আর সুরারোপিত বেসিক সং এর মধ্যে লব্ধপ্রতিষ্ঠ গীতিকার ও মান্না দের বিশেষ বন্ধু পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা হৈমন্তী শুক্লা কে দিয়ে গাওয়ানো অশ্রুথরথর বিরহ বেদনার এক অসাধারণ গান “আমার বলার কিছু ছিলো না” তাঁর এক কালজয়ী সৃষ্টি। হৈমন্তী শুক্লারই গাওয়া মান্না দের সুরারোপিত “ঠিকানা না রেখে ভালোই করেছ”, এবং আশা ভোঁসলের গাওয়া “আমায় তুমি যে ভালোবেসেছো”, “আমি খাতার পাতায় থাকতে চেয়েছিলাম”, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া “আমার মনকে নিয়েই আমার যত ভাবনা”—গানগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
অনেকেই হয়তো জানেন না যে, মান্না দে বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও ভারতবর্ষের আরও প্রায় ১২-১৩টি আঞ্চলিক ভাষাতে গান করেছিলেন। –যেমন মারাঠি, গুজরাটি, কান্নাড়া, মালয়ালম, ওড়িয়া, অসমীয়া, পাঞ্জাবী, ভোজপুরী, কোঙ্কনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে সলিল চৌধুরির সুরে মালয়ালম ছবি “চেম্মিন” এ গাওয়া “মানসম্যায়নে ভ্রু” গানটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তা একসময় কেরালার প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে জাতীয় সঙ্গীতের মতোই বাজতো। কান্নাড়া ছবি “কলাবতী” তে গাওয়া মান্না দের “কুহু কুহু” গানটি বা পাঞ্জাবী ছবি “দুখ ভজন তেরা নাম” এ গাওয়া “ম্যায় আন্ধালে কি টেক তেরা নাম” গানটিও একসময়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানাতে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরত বলে শোনা যায়।

manna dey9যাক ফিরে আসি সেদিনের সেই সঙ্গীতানুষ্ঠানের পর্বে। আমার দেখা মান্না দের শেষ লাইভ ফাংশন সেইটাই। সেদিন একটানা প্রায় ২ ঘণ্টা সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন মান্না দে। তার মধ্যে যেমন নিজের পছন্দ মতো গান ও শুনিয়েছিলেন শ্রোতাদের তেমনি শ্রোতাদের অনুরোধের গানও গেয়েছেন। আর কি আশ্চর্য তাঁর স্টেজ পারফর্মের দক্ষতা। নবতিপর এই শিল্পী একদিকে যেমন “লাগা চুনরী মে দাগ” গাইছেন” তেমনি সেই গানের শেষ তারানা অংশে ভৈরবী রাগের সুর মূর্ছনা” ছড়িয়ে দিচ্ছেন স্টেজ়ে বসেই নৃত্যরত ভঙ্গিতে ও হারমোনিয়ামে চাপড় মেরে তবলচী, কি বোর্ড, গীটার ইত্যাদি যন্ত্রসঙ্গীত সহশিল্পীদের সাথে সঙ্গত করে। সেই নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সেও তিনি যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের একপ্রকার নিয়ন্ত্রন করছেন। আর আজকাল উল্টোটাই দেখা যায়। গায়ক কে নিয়ন্ত্রন করছেন যন্ত্রশিল্পীরা। নব্বই বছরেও মান্না দের এই গায়ন দক্ষতা বস্তুতঃই তাঁর সুদীর্ঘ সঙ্গীত জীবনের শিক্ষালব্ধ জ্ঞানের এক অপরিসীম শক্তির বহিঃপ্রকাশ। আর গানের মাঝে মাঝে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে টুকরো টুকরো কথা শ্রোতাদের যে কিরকম উপভোগ্য হয়েছিলো তার দু একটা উদাহরণ দি। আমি নিজে অনুরোধ করেছিলাম “কফিহাউসের সেই আড্ডাটা”, “চার দেওয়ালের মধ্যে” ও “পুছো না ক্যায়সে ম্যানে”এই তিনটি গাইতে। প্রথম গানটি টি শোনালেন”। পরের গানদুটির ক্ষেত্রে তাঁর সকৌতুকে জবাব “এই বয়সে ওই গান আর হয় ? গাইলে তা শুনে আপনাদেরই রাগ হবে”। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিরহের এক অনবদ্য গান “তুমি অনেক যত্ন করে আমাকে দুঃখ দিতে চেয়েছো” শুরু করলেন। দু লাইন গাওয়ার পরে থেমে গেলেন গানের খাতায় খুঁজে পাচ্ছেন না। সামনের সারিতে বসা এক দর্শক নিজেই গেয়ে উঠলেন থেমে যাওয়া অংশের পর থেকে। সেই সঙ্গীতপ্রেমীর উদ্দেশ্যে নবতিপর শিল্পীর মন ছুঁয়ে যাওয়া মন্তব্য, “আচ্ছা বলুন তো এখানে উপস্থিত আপনাদের কতজনের মনের কথা বলে দিচ্ছি এই গানের মাধ্যমে”। গোটা হল ফেটে পড়লো হাততালিতে। অথচ যাঁর গলায় বিরহের গান একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল জীবনের সায়াহ্নে এসেও পত্নীপ্রেমে তাঁর কি অপরিমেয় নিবিড়তা !! তা যেন সাগরের মতই অতল গভীর। সেদিনের অনুষ্ঠান শুরুর আগে গ্রীন রুমে গেছি। দেখতে পেলাম শিল্পী বসে আছেন তাঁর জীবনসঙ্গিনীর পাশে । দুজনে একান্তে আলাপচারিতার মগ্ন। দেখে মনে ঠিক যেন জীবনের প্রথম ভাগে এক কিশোর ও কিশোরীর প্রেমিক মনের আদান প্রদান। মান্না দে বহুবার বলেছিলেন যে তাঁর সারাজীবনের সঙ্গীত সাধনার অন্যতম প্রেরণা তাঁর সহধর্মিণী সুলোচনা। তাই হয়তো পত্নীর আগে চলে যাওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। স্ত্রী বিয়োগের পরে এক নিদারুণ মনোকষ্টে দিনযাপন করছিলেন। স্ত্রী জীবিত থাকলে হয়তো সঙ্গীত নিয়ে আরো কয়েকবছর বেঁচে থাকার প্রেরণশক্তি পেতেন। দুর্ভাগ্য আমাদের। জীবনের শেষ অঙ্কে এসে ভাঙা হ্দয় নিয়েই চলে গেলেন। তবু বাংলা তথা ভারতবাসীর সাঙ্গীতিক মানসে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকালের জন্য। যতদিন পৃথিবীতে সঙ্গীত সাধনা, সঙ্গীত চেতনা বেঁচে থাকবে মান্না দে ততদিন মনের মণিকোঠায় অনির্বান দীপ্তি নিয়েই ভাস্বর হয়ে থাকবেন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.