আলাপন, বাংলাটাই ভুলে গেলেন!

(ঠিক চার বছর আগে। সেবার পুরসভা ভোটের আবহ। এমনই পরিস্থিতি, নির্বাচন কমিশনার বাধ্য হলেন পদত্যাগ করতে। তড়িঘড়ি নির্বাচন কমিশনার করা হল আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ঝরঝরে বাংলা বলা আলাপন কেন হঠাৎ ইংরাজি বলতে শুরু করলেন?‌ সেই সময়ের আবহে লেখা একটি খোলা চিঠি। ফিরিয়ে আনা হল বেঙ্গল টাইমসে।)

স্বরূপ গোস্বামী

বহুদিন ধরে আপনাকে চিনি। তা প্রায় দুই দশক হল। এত এত আই এ এসের ভিড়ে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আলাদা করে চিনতাম কেন ? আপনার অসাধারণ বাংলার জন্য। কী সুন্দর, কী ঝরঝরে আপনার বাংলা।
যতদূর মনে পড়ছে, আপনি যখন বাংলা বলতেন, তার মঝে একটিও ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করতেন না। এমনকি যে ইংরাজি শব্দগুলো দৈনন্দিন ব্যবহারে প্রায় বাংলাই হয়ে গেছে, আপনি সেগুলোকেও সন্তর্পণে এড়িয়ে চলতেন। এই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দুজনের তুলনা করা যায় কান্তি বিশ্বাস ও অসীম দাশগুপ্ত। তাঁরাও বাংলা বলতেন ঠিকই, তবে আপনার বাংলার মতো এত শ্রুতিমধুর ছিল না। কী সাবলীল ছিল আপনার শব্দচয়ন!
পরে জানলাম, আপনি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জামাই। পরের দিকে আপনার বাংলার কথা উঠলেই বলতাম, ‘হবে না! কার জামাই দেখতে হবে তো!’ বাঙালির সকাল সন্ধ্যা নিয়ে কী ঝরঝরে একটা বই আপনি লিখেছিলেন। নোয়াম চামস্কির সঙ্গে সেই অনব্য আড্ডা, আর সুন্দর উপস্থাপন। আপনার লেখনীতেই তো চিনেছিলাম চামস্কিকে।

alapan2

এত বাঙালির ভিড়েও আপনাকে আলাদা করে চিনতাম বাংলার জন্য। এত আমলার ভিড়েও আপনি ছাপ ফেলেছিলেন আপনার মার্জিত রুচি ও আচরণের জন্য। এক সময় সাংবাদিকতা করেছেন। হয়ত সেই কারণেও অন্য আমলাদের চেয়ে আপনাকে বেশি কাছের মনে হত। আর ‘আলাপন’ নামটার সঙ্গেও অনেক আবেগ, অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
তারপর গত প্রায় একদশক, আপনার প্রতিবেশী। রোজ সকালে আপনি হেঁটে বাজার করতে যান। সাধারণ একটা পাজামা আর অতি সাধারণ টিশার্ট গায়ে। কখনও গায়ে জড়ানো হালকা চাদর। আই এ এস সুলভ গাম্ভীর্য তো দূরের কথা, একেবারেই সাধারণ সেই হেঁটে যাওয়া। চেনাজানা লোকের সঙ্গে দেখা হলে মৃদু হাসি বিনিময়। ঔদ্ধত্য নামক শব্দটা আপনার ধারেকাছেও সেভাবে ঘেঁসতে পারেনি। মনে হত, যথার্থ শিক্ষিত, যথার্থ গুণী মানুষেরা বোধ হয় এরকমই হয়ে থাকেন।
হঠাৎ করে আপনি যেন গণশত্রু হয়ে গেছেন। কারণে-অকারণে অনেক আপনাকে আক্রমণ করে বসছেন। বলা হচ্ছে, ‘আপনি বরাবরই সরকারের কাছের লোক। আগে বুদ্ধবাবুর লোক ছিলেন, এথন মমতার লোক।’ বুদ্ধবাবুর রুচিবোধ সম্পর্কে আমি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। যতটা না রাজনৈতিক কারণে, তার থেকে বেশি সংস্কৃতিমনস্কতার কারণে। এমন একজন সংস্কৃতি মনস্ক মানুষের প্রতি যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আলাদা অনুরাগ ও স্নেহ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আরে বাবা, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যাযকে ভাল না বেসে পারা যায়! মমতার কাছে আপনি কেন প্রিয়, তা অবশ্য জানি না। যতই তাঁর খান চল্লিশেক বই থাক, যতই তিনি কথাঞ্জলি লিখুন, তাঁর রুচিবোধের সঙ্গে আপনার রুচির বৈপরীত্ব অনেকটা ঋত্বিক ঘটক আর ঋত্বিক রোশনের মতোই। আপনি কী করে তাঁর আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন, সে বিস্ময় আছে, থাকবেও।

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়েছিলেন ভুটানে। ভাবতেও পারেননি বিমান বন্দর থেকে বাড়ি নয়, সোজা ছুটতে হবে নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে। হঠাৎ এই দায়িত্ব নিলেন কেন, এই প্রশ্ন না করাই ভাল। এটুকু বুঝি, এই দায়িত্ব আপনার কাছে কাম্য ছিল না। একজন মার্জিত রুচির মানুষ কখনও এমন বিড়ম্বনায় পড়তে চায়!
কেমন ভোট হয়েছে, দেখেই ভুটানে গেছেন। পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। প্রযুক্তির ব্যবহারেও বেশ দক্ষ। ভুটানে বসেও দিব্যি খবর পেয়েছিলেন, সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের উপর কী রকম সন্ত্রাস হয়েছে । কেন তাঁকে মাঝপথে দায়িত্ব ছাড়তে হল, তা আমাদের চেয়ে ঢের ভাল জানেন আপনি। কেন আপনাকে বসানো হচ্ছে, এটাও আপনি জানতেন। হ্যাঁ, সরকারি চাকরির কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে। সবসময় ‘না’ বলা যায় না। তাই হয়ত রাজি হতে হয়েছিল।
আপনি যে পুরো নির্বাচন বাতিল করে দেবেন, এতটা বিপ্লব কেউ আশাও করেনি। তবে মাত্র নটা বুথে পুনর্নির্বাচন? রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বা আক্রান্ত মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। আরেকটু সময় নিয়ে আরেকটু খতিয়ে দেখতে পারতেন। আর তিন চারদিন না হয় দেরিই হত। হাইকোর্টে মামলা চলছিল। রায় পর্যন্তও অপেক্ষা করা যেত। বিরোধীদের আস্থা অর্জনের একটা সুযোগ হয়ত পেতেন। কিন্তু তড়িঘড়ি নির্বাচন ডেকে দিলেন।
এটাই আপনার প্রথম নির্বাচন। এটাই আপনার শেষ নির্বাচন। কয়েকদিন পরেই হয়ত ফিরে যাবেন পরিবহন সচিবের চেয়ারে। বিদ্রোহী টি এন শেষন নাই বা হলেন, সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে নাই বা গেলেন, অন্তত কিছুটা ব্যতিক্রমী ছাপ তো রাখতে পারতেন। একটাই নির্বাচন, যত শান্তিপূর্ণই হোক, ভোট পড়ল মাত্র তিরিশ শতাংশ, সব বিরোধীরা একযোগে বয়কট করলেন। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিটা কি খুব উজ্জ্বল হল ?
এসব লিখব ভাবিনি। কেন জানি না, লিখে ফেললাম। আসল কষ্টটা অন্য জায়গায়। গত দুদিন আপনার সাংবাদিক সম্মেলন দেখে। আপনার বাংলার কী হল! একের পর এক বাংলায় প্রশ্ন আসছে, আর আপনি ইংরাজিতে তার উত্তর দিয়ে চলেছেন। কোনওটা বাংলায় শুরু করছেন, দু লাইন বলেই ইংরাজির আশ্রয় নিচ্ছেন। তবে কি বাংলায় বললে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হবে, এটা আঁচ করে ইংরাজির আশ্রয়? বাংলায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বারবার আপনাকে হোঁচট খেতে হল। বেশ কয়েকবার আমতা আমতা করলেন। আজ, শুক্রবার। ভোটের পরেও একই দৃশ্য। বাংলা বলতে গিয়ে বারবার আপনি হোঁচট খাচ্ছেন। অতিরিক্ত সতর্ক। পাছে বেফাঁস কিছু বেরিয়ে যায়, তা নিয়ে আবার মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠবে!

alapan, sushantaranjan

কোনও সন্দেহ নেই, ইংরাজিটাও আপনি যথেষ্ট ভাল বলেন। কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতিতে সারা বাংলা আপনার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা তো বাংলা কথাটাই শুনতে চাইছিল। মিডিয়ার সিংহভাগ তো বাঙালিই। দু একজন যদি সর্বভারতীয় মিডিয়ার প্রতিনিধি থেকেও থাকেন, তাঁর জন্য পরে দু চার লাইন আলাদা করে ইংরাজি বলাই যেত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে ইংরাজিটা সম্পূর্ণ অকারণে।
মানছি, আপনি এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছেন। এখান থেকে বেরিয়ে আবার নবান্নে গেলে আপনি হাফ ছেড়ে বাঁচবেন। কিন্তু এই দু তিন দিন আপনাকে সারা বাংলা দেখল। এমন সুন্দর বাংলা শুনে সেই মায়েরা হয়ত কিছুটা শিখতে পারত, যারা বলে থাকেন, ‘জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।’ বাংলা মাধ্যমে পড়েও, ঝরঝরে বাংলায় কথা বলেও এমন একজন আই এ এস অফিসার হওয়া যায়।
বিশ্বাস করুন, আপনি কেন মাত্র নটা বুথে পুনর্নিবাচন করালেন, তা নিয়ে বিশেষ রাগ নেই। সে আপনার সরকারি বাধ্যবাধতা। কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারি। বেশি খারাপ লাগছে, আপনি বাংলা থেকে পালিয়ে ইংরাজির আশ্রয় নিলেন!
না, এখানে আপনাকে ভাল লাগছে না। ফিরে যান আপনি নবান্নে। বা অন্য কোথাও। যেখানে আপনি প্রাণখুলে বাংলা বলতে পারবেন।

 

(‌গত সাড়ে চার বছর ধরে এমন অসংখ্য লেখা ছড়িয়ে আছে বেঙ্গল টাইমসে। যার অনেক লেখাই এখনও আর্কাইভে আছে। চাইলেই পড়া যায়। সেই সময়টাকে যেমন চেনা যাবে, ঠিক তেমনি সেই সময়ে বেঙ্গল টাইমসের কী ভূমিকা ছিল, তাও বোঝা যাবে। আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতেই পারেন। )‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.