বোঝা গেল, উন্নয়নে কারও আস্থা নেই

সরল বিশ্বাস

দ্বিতীয় দফার ভোটেও ছবিটা বদলালো না। নির্বাচন কমিশন বলতেই পারে, বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিপূর্ণ। পেটোয়া কাগজ বা চ্যানেলগুলি বলতেই পারে, উৎসবের মেজাজে ভোট। ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা বলতেই পারেন, এমন ভোট রাজ্যে আগে কখনও হয়নি।

আসলে, ভোটের ছবিটা কেমন, তা যাঁরা টিভিতে চোখ রেখেছিলেন, কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। দুপুর থেকে নেত্রীর তিন তিন খানা সভা। ঝেড়ে উন্নয়নের খতিয়ান, কেন্দ্রকে আক্রমণ, আর কালীমন্ত্র। তাঁর সভা মানেই টিভিতে লাইভ। ব্যাস, দুপুরের পর থেকে আপনি আর কিছুই ‘‌লাইভ’‌ দেখতে পেলেন না। যে নিস্তরঙ্গ দুপুরে বুথ কার্যত ফাঁকা থাকে, যেটা ‘ছাপ্পা সংস্কৃতি’‌র মোক্ষম সময়, সেই সময়েই তিনি লাইভ ফুটেজ খেয়ে নিলেন। সরাসরি তাঁর ভাষণ। অতএব, ভোট সম্প্রচার মুলতুবি। দিনের শেষে নির্বাচন কমিশনের ভাষণ, দারুণ ভোট হয়েছে। ব্যাস, আপনিও ভাবলেন, দুপুরের পর থেকে যখন কিছুই দেখিনি, তখন নিশ্চয় শান্তিপূর্ণই হয়েছে।

chopra

তিনি এত উন্নয়নের বন্যা এই রাজ্যে বইয়ে দিয়েছেন, যে বিরোধীদের খুঁজেও পাওয়ার কথা নয়। একশো শতাংশ ভোটই তো তাঁর। তবু তাঁকে প্রতি সভায় নিয়ম করে বিরোধীদের কুরুচিকর ভাষায় গাল পাড়তে হয়। বলতে হয়, বাম, কংগ্রেস, বিজেপি সবার নাকি সেটিং আছে। আরে বাবা, আপনার যদি একান্ন শতাংশ ভোট থাকে, সারা পৃথিবীর সেটিং থাকলেও তো আপনিই জিতবেন। তাহলে এত দুশ্চিন্তার কী আছে?‌

এতই যদি উন্নয়নের বন্যা, তাহলে একেকটা কেন্দ্রে এই ধুপসি রোদে চার–‌পাঁচটা করে সভা করতে হচ্ছে কেন?‌ বিরোধীদের সব প্রচার আটকানোর জন্য ডিএম–‌এসপিদের লেলিয়ে দিতে হচ্ছে কেন?‌ বিরোধী প্রার্থীদের আক্রান্ত হতে হচ্ছে কেন?‌ আসল কথা হল, জেলার নেতারা বুঝে গেছেন, উন্নয়নের অষ্টরম্ভা দিয়ে জেতা যাবে না। তাঁরা ভাল করেই জানেন, উন্নয়ন কতখানি আর কাটমানি বা সিন্ডিকেট কতখানি। তাঁরা জানেন, বালি থেকে কয়লা, গরু থেকে তোলা, সাইকেল থেকে নীল সাদা রঙের কাটমানি কোথায় যায। সর্বময়ী নেত্রী যতই ‘‌উন্নয়ন–‌উন্নয়ন’‌ করে বেড়ান, জেলা নেতা থেকে ব্লক নেতা ভাল করেই জানেন, ওই ফাঁপা প্রচারে কিচ্ছু হবে না। পুলিশ, লাঠি, বোমা, ভয় এগুলোই অস্ত্র। তাঁরা সেই অস্ত্র নিয়েই নেমেছেন। একটি বা দুটি বুথে নয়। প্রায় প্রতিটি ব্লকে।

chopra2

এত এত সভা। যেটুকু লোক হচ্ছে, তারা আসলে কারা?‌ একটু মুখগুলো দেখুন তো। আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি, সিভিক ভলান্টিয়ার, প্যারা টিচার, লোকশিল্পী— এঁদের সংখ্যাই সত্তর শতাংশের বেশি। বাকি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নানাভাবে যাঁরা উপকৃত, তাঁরা। অর্থাৎ, অধিকাংশই ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি। স্থানীয় নেতারা সত্যিই বড় অসহায়। লোক পাওয়া যাচ্ছে না। বারবার সব সভায় তাঁদেরই ধরে ধরে আনতে হচ্ছে। চাকরি খেয়ে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে এঁদের সভায় হয়ত আনা যায়। চাইলে মিছিলেও হাঁটানো যায়। কিন্তু সেই ভোটগুলো ইভিএমে ঠিকঠাক জায়গায় পড়বে তো?‌ বারবার জোর করে মিটিংয়ে নিয়ে যাওয়ার রাগটা ইভিএমে প্রকাশ পাবে না তো?‌ যাঁরা সভায় আসছেন, শুধু তাঁরাই যদি ভোট দেন, সেই ভোটও তৃণমূল কত শতাংশ পাবে, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর পঞ্চায়েতে যাঁরা ভোট দিতে পারেননি, তাঁদের ক্ষোভের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাই, ভোট হলেই মহা বিপদ। কোনও ‘‌উন্নয়ন’‌এর গল্পেই চিঁড়ে ভিজবে না।

অতএব, একটাই পথ। বানচাল করো। তাই, কেন্দ্রীয় বাহিনীতে এত আপত্তি। তাই রাজ্য পুলিশে এত আস্থা। বিরোধীরা উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই উন্নয়নের খতিয়ানে তৃণমূল নেতাদের কতখানি আস্থা, তা ভোটের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। তাহলে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত না। তাহলে সাংবাদিক পেটাতেও হত না, ক্যামেরা ভাঙতেও হত না। এত উন্নয়নের পরেও লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। এটা কার হার?‌ এটা কার লজ্জা?‌ এটা কার গালে থাপ্পড়?‌ ভোটারদের অনাস্থা তো পরের কথা, আগে নিজের দলের লোকেদের এই প্রবল অনাস্থা হজম করুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.